গরু

গরু

গরু একটি গৃহপালিত তৃণভোজী প্রাণি। আদিকালে গরু চাষাবাদ, পন্য পরিবনে ও পুষ্টির উৎস হিসাবে পালন করা হতো। তবে বর্তমান সময়ে দুধ, মাংস ও চামড়া উৎপাদনই মুল উদ্যেশ্য হিসাবে বিবেচনা করা যায়। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ট ভাবে জরিয়ে আছে এই প্রাণি।

একটি সুস্থ জাতী গঠনে গরুর ভূমিকা অপরিশিম। এটি দুধ ও মাংসের প্রধান উৎস।

বিবরণ

গরু একটি চতুষ্পদ প্রাণী। এদের গায়ের রং বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কখনো সাদা, কখনো কালো, কখনো বা সাদা-কালো, কখনোবা সাদা-লাল, এইরকম বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সারা পৃথিবীতে পাওয়া যায়। আমাদের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের  গরুর  গায়ের লোম ছোট ছোট হয় কিন্তু শীতপ্রধান দেশের গরুর শরীরে লোম বড় বড় লম্বা লম্বা হয়ে থাকে।

গরুর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য

  1. এদের ঘ্রাণশক্তি প্রখর; এটি প্রায় ৬ মাইল দুরের গন্ধ শুঁকে নিতে পারে।
  2. এরা গড়ে প্রতিদিন ৪০,০০০ বার তার চোয়ায় উঠানামা করে।
  3. এরা কখনো বমি করতে পারে না।
  4. এরা লাল ও সবুজ রঙে বর্ণান্ধ।
  5. এদের পাকস্থলীতে প্রায় ৫০ গ্যালন খাবার ধারণ করতে পারে।
  6. এরা প্রতি মিনিটে ৫০ বার চিবোয়।
  7. এদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১০০-১০২ ডিগ্রী ফানেরহাইট।
  8. এরা প্রতি মিনিটে ১০-৩০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে।
  9. এদের প্রতি মিনিটে ৬০-৭৫ বার হৃদস্পন্দন হয়।
  10. একটি গাভী ২৭৫-২৮৫ দিন গর্ভাবস্থায় থাকে।
  11. একটি গাভী ২৮০-৩০০ দিন দুগ্ধদান করে।
  12. একটি গাভী তার জীবন দশায় ১০ বার গর্ভধারণ করে।
  13. গরু দিনে মাত্র ৩.৯ ঘন্টা ঘুমায়।
  14. এদের শরীরে ২০৭ টি হাড় থাকে।
  15. একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর চোয়ালে ৩২ টি দাঁত থাকে।
  16. এরা মাটি হতে চার ইন্চি উচু থেকে খেতে পছন্দ করে।
  17. এরা তৃণ ভোজী প্রাণি।
  18. গরুর পাকস্থলী ৪ প্রকস্ঠ বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
  19. এদের পাকস্থলী আঁশজাতীয় ঘাদ্য হজম উপযোগী।
  20. এরা জাবর কাটা প্রাণি, জাবর না কেটে হজম করতে পারে না।
  21. ব্রাজিলের ম্যারিলিয়া (Marília) নামের একটি গাভি এক দিনে ১২৭,৫৭০ কেজি দুধ দিয়ে রেকর্ড স্থাপন করেছেন।
  22. ইটালির চিয়ানিনা (Chianina) জাতের গরুর ওজন সবচেয়ে বেশি (১৭০০ কেজি) হয়।
  23. বিশ্বের সবচেয়ে ছোট জাতের গরুর নাম ভেচুর (Vechur)। এরা ৯০ সেন্টিমিটার উচু ও ১২৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয়।
  24. বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দুধ প্রদানকারী জাতের গাভী হলো হলস্টিন ফ্রিজিয়ান।
  25. গরুর গড় আয়ু ১৮-২২ বছর।
Vechur Cow
চিত্র: ভেচুর জাতের গরু

উল্যেখযোগ্য কয়েকটি জাত

পুরো প্রথিবীতে গরুর অনেক প্রকার জাত ও উপজাত রয়েছে। কোনটি অধীক দুধ উৎপাদন করে আবার কোনটি অধীক মাংস উৎপাদন করে। কোনটির আকার হাতির মত বড় আবার কোনটির আকার ছাগলের চেয়েও ছোট। নিচে কয়েকটি প্রশিদ্ধ জাত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

চিয়ানিনা

এক কথায় বলতে গেলে এই জাতটি খুব আকর্ষণীয়! মূলত চাষাবাদ ও পরিবহনের জন্য আদীকাল থেকে পালন করা হতো তবে দ্রুত বর্ধণশীল এই জাতটি এখন মাংস উত্পাদন এবং প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়। মাংসের গুণগত মান পরিবর্তনের জন্য কৃষকরা প্রায়শই অন্যান্য জাতের সাথে এই গরু জাত দিয়ে প্রজনন করেন।

Chianina Cow
চিত্র: চিয়ানিনা গরু

হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান

দ্য হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান, এটি কেবল “হলস্টাইন” নামে পরিচিত, এটি হ’ল “দুধের গাভী”। আপনি যখন দুধের কথা ভাবেন তখন এটিই কালো এবং সাদা সংস্করণ এবং আপনি প্রায় প্রতিটি দুধের প্যাকেটে দেখান। মূলত নেদারল্যান্ডসের ফ্রিজল্যান্ড এবং জার্মানির শ্লেসভিগ-হলস্টেইনে ক্রসে এই জাতটি জন্মায়।

টেক্সাস লংহর্ন

বিক্ষ্যাত এই জাতটি তার বিশাল দেহ ও প্রসস্ত শিং জন্য সর্বাধিক পরিচিত। টেক্সাস লংহর্ন ষাঁড়টি সাত ফুট পর্যন্ত জুড়ে এক জোড়া শিং খেলতে পাওয়া যায়।

আমেরিকান ব্রাহমা

এই ব্রাহমা জাতটি মুলত ভারতীয়। তবে আমেরিকায় এই জাতের উন্নয়ন ঘটান হয়েছে। দ্রুত বর্ধনশীল ও মাংস উৎপাদনকারী ষাঁর হিসাবে পৃথিবী ব্যাপি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

দেশি জাতের গরু

শুধুমাত্র রেড চিটাগাং জাতকেই দেশীয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে সত্তিকার অর্থে এটি জাত হিসাবে শিকিৃতি পায়নি। এই জাতের গঠন মোটামুটি বড় হয়। দেখতে লাল ও সামান্য চুট দেখা যায়। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং পালন বেশ লাভজনক।

গরুর রোগ

গরুর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাকোপ্লাজমা, প্রটোজোয়া ইত্যাদি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়। এসকল রোগ অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দ্বাড়ায়। এছাড়াও পরজীবীর সংক্রমন ও অপুষ্টি জনিত কারনে রোগে আক্রান্ত হতে পারে। উল্যেখযোগ্য কয়েকটি রোগ হলো-

ক্ষুরারোগ (FMD)

এটি একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। একে ইংরেজি ভাষায় ফুট এন্ড মাইথ ডিজিস বলে। এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এছাড়াও এই রোগ দেখা দিলে উৎপাদন বহু গুণ কমে যায়। তবে টিকা প্রদান করলে ও খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো রাখলে গরুর ক্ষুরারোগ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

তড়কা (Anthrax)

এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত মারাত্বক সংক্রামক রোগ। এই রোগে মৃত্যুর হার প্রায় ১০০ ভাগ। রোগের লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে আক্রান্ত প্রাণিটি মারা যায়। তড়কা রোগ প্রতিরোধের মাধ্যম হলো টিকা প্রদান ও বায়োসিকিউরিটি মেনে চলা।

বোভাইন এফিমেরাল ফিভার (bovine ephemeral fever)

এটি একটি ভাইরাস জনিত সংক্রামক রোগ। আকস্মিক হয় এবং তিন দিন স্থায়ী থাকে বলে এ রোগকে তিন দিনের জ্বর বা থ্রি ডেজ সিকনেস বলে। রক্ত শোষক কীট-পতঙ্গ আক্রান্ত প্রাণী হতে সুস্থ পাণিতে ভাইরাস ছড়ায়। বোভাইন এফিমেরাল ফিভার রোগে আক্রান্তের হার ৫-১০০% এবং মৃত্যুর হার ২%।

গরু

ম্যাস্টাইটিস (Mastitis)

গাভী গরুর ম্যাস্টাইটিস বা ওলান পাকা রোগের ফলে খামারে দুধ উৎপাদনের পরিমান ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় ওলানে পচন ধরে যায়। গাভীর ওলান প্রদাহ বিভিন্ন প্রকার অনুজীব থেকে হয়ে থাকে।

দুধ ও দুধের পুষ্টিগুণ

গরুর দুধ একটি সুষম খাদ্য। এতে প্রোটিন ও ফ্যাট সহ অনেক প্রকার ভিটামিন, মিনারেল ও দরকারি নিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়। একটি সুস্থ্য ও বকুদ্ধিমান জাতি গঠনে দুধের বিকল্প নেইা। বার্বাডোজ এবং তাইওয়ানে গরুর দুধের দাম সবচেয়ে বেশি প্রায় চার ডলার প্রতি কেজি। তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়াতে দুধের দাম সবচেয়ে কম।

খাদ্য

তৃণভোজী প্রাণী দের মধ্যে অন্যতম। এরা সাধারণত ঘাস, লতাপাতা, খর বা বিছালী,বিভিন্ন প্রকার শস্যকণা, শস্যের আবরণ, বিভিন্ন প্রকার ফসলের কান্ড এবং গাছ ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। গরুর চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পাকস্থলী হওয়ায় এদেরকে রুমিনান্ট বলা হয়।

এরা সাধারণত খাবার গ্রহণ করার পর তা পুনরায় জাবর কাটার মাধ্যমে হজম ক্রিয়া সম্পন্ন করে।

এদের খাদ্য কি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা-  দানাদার খাদ্য ও কাঁচা ঘাস বা শুকনো খড়। কাঁচা ঘাস গরুর জন্য অত্যন্ত দরকারি একটি খাদ্য। কাঁচা ঘাস থেকে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন এবং মিনারেল পেয়ে থাকে। অন্যদিকে দানাদার খাদ্যের মাধ্যমে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট সহ অন্যান্য পুষ্টিগুণ পেয়ে থাকে।

প্রজনন

একটি গাভী প্রতিবছর একটি করে বাসর প্রসব করে। একটি গাভী তার জীবন দশায় 10 থেকে বারোটি বাচ্চা প্রদান করে। আদিকাল থেকে এদের প্রজনন ষাঁড় গরু দ্বারা ঘটানোর রীতি রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়া প্রায় সকল দেশেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন এমন একটি বিষয় যেখানে কৃত্রিম উপায়ে গাভীর জরায়ুতে শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়।

এই কৃত্রিম প্রজননের অনেক সুবিধা রয়েছে। একদিকে যেমন অধিক গাভীকে অল্প সময়ে বীজ দেওয়া যায় তেমনি জাতের উন্নয়ন ঘটানো যায়।

ডেইরি শিল্পে বিপ্লব ঘটেছে শুধুমাত্র এই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে। এখন চাইলেই আপনি একটি উন্নত জাতের গাভী বা  ষাড়ের মালিক হতে পারেন। যেটা কৃত্তিম প্রজনন ছাড়া কখনো সম্ভব হত না। তবে কৃত্রিম প্রজননের কিছু অসুবিধা রয়েছে। অনেক সময় অদক্ষতার কারণে গাভীর প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ সহ নানান ধরনের  প্রজননতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়।

আচরণ

গরু একটি শান্ত প্রকৃতির সামাজিক প্রাণী। এরা পরিবারের সদস্যের মতো বাড়িতে বা খামারে লালিত পালিত হয়। কখনো কখনো সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে এই প্রাণীটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের সাথে এই প্রাণীটির ব্যাপক সখ্যতা রয়েছে। এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। লালন পালনে নিয়োজিত ব্যক্তির কথা অনুযায়ী এরা পরিচালিত হয়।

যত্ন

সুস্থ রাখতে এবং গরুর উৎপাদন ঠিক রাখতে প্রয়োজন বাড়তি যত্ন। এদের প্রতি যত্নশীল নাহলে এরা বিভিন্ন প্রকার সংক্রামক ও পুষ্টির অভাবজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

  1. আমাদের আবহাওয়ায় প্রতিদিন 1 থেকে 2 বার গোসল করাতে হবে।
  2. এদের শরীরে যাতে মশা মাছির আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
  3. সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। অর্থাৎ কাঁচা ঘাস, খর, দানাদার খাদ্য ইত্যাদি দিতে হবে।
  4. খাবার পাত্রের পাশে পানির পাত্র রাখতে হবে। যাতে পশু তার প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান করতে পারে।
  5. প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।
  6. নিয়মিত খাদ্যে ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
  7. আবাসস্থল স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে তৈরি করতে হবে।
  8. পশুকে সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *