গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ বা এফএমডি ভাইরাস

গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ বা এফএমডি ভাইরাস

গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ বা এফএমডি ভাইরাস কী – লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে এই আলোচনায় আপনাকে স্বাগতম। আপনারা নিশ্চয় জানেন যে ক্ষুরা রোগ বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত ভাইরাস ঘটিত রোগ। বছরের যেকোনো সময় এ রোগ হতে পারে। বর্ষার শেষ থেকে সারা শীতকাল (সেপ্টেম্বর  থেকে জানুয়ারি) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগে বাছুরের মৃত্যুর হার ব্যাপক।

একটু সচেতন থাকলে এবং সময় মতো প্রতিষেধক টিকা প্রদান করলে গবাদিপশুকে সহজেই এ রোগ থেকে বাঁচান সম্ভব।

গরুর এফএমডি বা ক্ষুরা রোগ কী?

FMD in Cattle বা ক্ষুরা রোগ অতি তীব্র প্রকৃতির সংক্রামক ভাইরাস ঘটিত ছোয়াছে একটি রোগ। ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (FMD) ভাইরাস নামক একপ্রকার rNA ভাইরাস সংক্রমণের ফলে এ রোগ হয়ে থাকে।

এটিকে ফ্যাট ইনভেলাপ ভাইরাস ও বলা হয়। এ রোগে আক্রান্ত গরুর মুখ ও পায়ের ক্ষুরে ঘাঁ বা ক্ষত সৃষ্টি হয়। এর ফলে গরু খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না এবং খুঁড়িয়ে হাটে। শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়।

আমাদের বাংলাদেশে ক্ষুরারোগের প্রাদুর্ভাব খুবই বেশি দেখা যায়।

গরুর ক্ষুরা রোগের কারণ

ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (FMD) নামক এক প্রকার ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টি করে থাকে। ইংরেজিতে ক্ষুরা রোগের ভাইরাস কে এফ,এম,ডি বলে। এ ভাইরাসের মোট ৭টি টাইপ বা স্টেইন আছে বলে যানা যায়। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এশিয়া-১ টাইপের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশ ক্ষুরা রোগ মুক্ত

ক্ষুরা রোগের বিস্তার

এই ভাইরাস টি খুবই ছোয়াছে এবং বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগ এতোটাই সংক্রামক যে কোনো এলাকায় এ রোগ দেখা দিলে একশত ভাগ পশুই তাতে আক্রান্ত হয়। গরুর হাটের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে সংক্রমন হয়।

  • এই ভাইরাস সাধারণত রোগাক্রান্ত প্রাণীর ফোসকা ফেটে অন্য প্রাণীর দেহে  বিস্তার লাভ করে।
  • রোগাক্রান্ত গরুর লালা, মল-মুত্র ও দুধের মাধ্যমে দেহ হতে বের হয়ে আসে।
  • এই ভাইরাস আক্রান্ত পশুর খাদ্য, পানি, আবাসস্থল কে কলুষিত করে। বাতাসের সাহায্যে ফএমডি ভাইরাস ৬০-৭০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • আক্রান্ত পশুকে দূর-দূরান্তের হাট-বাজারে বিক্রির জন্য নেয়া হলে ভাইরাস ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং  ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়।
  • আক্রান্ত পশুর পরিচর্যাকারীর সাহায্যে এই ভাইরাস বিভিন্ন খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ক্ষুরা রোগের লক্ষণ

গরুর সবচেয়ে মারাত্মক ভাইরাস ঘটিত রোগটি হলো ক্ষুরা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত প্রাণীর শরীরে অনেকগুলো লক্ষ্মণ প্রকাশ পায়। এসকল লক্ষ্মণ দেখে খামারিরা সহজেই এই রোগ সনাক্ত করতে পারে।

  • প্রথমে জ্বর হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর মধ্যে থাকে।
  • গবাদিপশু শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে।
  • প্রাণীর মুখের ভেতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝে ফোসকা হয় যা পরে ফেটে লাল ক্ষতের সৃষ্টি করে।
  • আক্রান্ত পশুর মুখ থেকে ফ্যানার মত লালা পড়তে থাকে এবং পশুটি কিছু খেতে পারে না। ফলে পশু মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • পা ফুলে যায় ও প্রচন্ড ব্যথা হয়। ঘাঁ বেশি হলে চলা ফেরা করতে পারে না।
  • পায়ের ক্ষুরের ক্ষত স্থানে মাছি ডিম পাড়লে পোকা তৈরি হয়। এর ফলে পশু অনবরত পা ছুড়তে থাকে। যেন পায়ে  কিছু লেগে আছে।
  • ক্ষুরা রোগের সংক্রমন বেশি হলে ক্ষুর বা জিহ্বা খসে পড়তে থাকে।
  • গাভীর ক্ষেত্রে ওলানে ফোসকা হতে পারে, এতে ওলান ফুলে উঠতে পারে এবং দুধ কমে যায়।
  • সাধারণত বাছুরের এ রোগ হলে অধিকাংশ বাছুরই মারা যায়।
  • ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত পশু শ্বাসকষ্ট, রক্ত শূন্যতা এবং উচ্চ তাপমাত্রায় কাহিল হয়ে পড়ে ।
ক্ষুরা রোগ

ক্ষুরা রোগের ক্ষতিকর প্রভাব

ক্ষুরা রোগ গবাদিপশুর শরীরে এবং সর্বপরি গো খামারে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এই ভাইরাস টি মারাত্মক মর্টালিটি তৈরি করে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক হওয়ায় প্রতি বছর অসংখ্য পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

এদের মধ্যে বাছুরের মৃত্যুর হার বেশি। এ রোগের ফলে খামারে দুধ ও মাংসের উৎপাদন হ্রাস পায়। গর্ভবতী গাভী সংক্রমিত হলে গর্ভপাত হয় এবং কখনো কখনো বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

মেটাতাজাকরণ গরুর ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হলে গরুর ওজন কমে যায় এবং একটি লম্বা সময় গরুর বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
 

এফএমডি প্রতিকার

পৃথিবীর অনেক দেশ ক্ষুরা রোগ মুক্ত। এসব দেশের মধ্যে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। এসব দেশে হঠাৎ কোনো স্থানে ক্ষুরা রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত পশুকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক বলে অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

  • আক্রান্ত প্রাণীকে সুস্থ প্রাণী থেকে আলাদা  করে পরিষ্কার ও শুষ্ক স্থানে রাখতে হবে। কোনো ভাবেই  কাদা বা ভেজা স্থানে রাখা যাবে না।
  •  এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে প্রকৃতির হয়। তাই আক্রান্ত পশুকে অন্য এলাকায় নেয়া এবং বাইরের কোনো আক্রান্ত পশুকে এ এলাকায় আনা কোনোভাবেই উচিৎ না।
  • আক্রান্ত এলাকার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল সুস্থ গরুকে যত তারাতাড়ি সম্ভব এফএএমডি রোগের টিকা  দিতে হবে।
  • আক্রান্ত গরু কে নরম বা তরল খাবার, যেমন- ভাতের মাড় খেতে দিতে হবে।
  •  এ রোগে আক্রান্ত পশুর সেবাযত্ন কারির ব্যবহৃত কাপড়, হাত, পা এবং অন্যান্য জিনিস অবশ্যই জীবাণু নাশক ঔষধ দ্বারা ধুয়ে জীবানু মুক্ত করে নিতে হবে।
  • এই রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
  • ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত পশুকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
  •  পশুর ঘর বা সেড সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

ক্ষুরারোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই বেশি কার্যকর। আর তাই ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের জন্য কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এবং গবাদিপশুকে প্রতি ৬ মাস পরপর এ রোগের প্রতিশোধক টিকা দিতে হবে। এতে এ রোগের  প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদের দেশের খামার গলো কে রক্ষা করা সম্ভব হবে। 

ক্ষুর রোগের ভ্যাকসিন বা টীকা

এই রোগের একমাত্র প্রতিরোধ এর ভ্যাকসিন বা টীকা প্রদান করা। ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন বর্তমান সময়ে খুবই এভেলাবেল। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারী প্রণি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ এই ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বেসরকারী পর্যায়ে বেশ কয়েকটি কম্পাণী এই রোগের ভ্যাকসিন মার্কেটিং করে। তবে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজটি দক্ষতার সাথে করতে হবে।

ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা

গরুর ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ তাই এই রোগের সঠিক কোন চিকিৎসা নেই। ভাইরাসটি এখন অনেকটা দুর্বল হয়েছে। সঠিক পরিচর্যা করলে অনেক সময় রোগটি ভালো হয়ে যায়। তবে বাছুরের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এই রোগ দেখাদিলে প্রথমে আক্রান্ত প্রাণিকে আলাদা করতে হবে এবং উপজেলা প্রানী স্বস্থ্য কর্মকর্তার নিকট পরামর্শ ক্রমে ঔষধ খাওয়াতে হবে।

ক্ষুরা রোগের ঔষধ

প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে জ্বর ও ব্যাথার জন্য প্যরাসিটামল বা কিটোপ্রোাফেন গ্রুপের ঔষধ পশুর ওজন অনুযায়ী দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও মুখের ও পায়ের ক্ষত জায়গা ’এফএমডি কিওর’ নামের লিকুইড সলুশন দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

পায়ের ক্ষতে ‘সুলিড ভেট’ নামের একটি পাওডার লাগিয়ে রাখলে মশা মাছি বসে না এবং ঘাঁ দ্রুত ভালো হয়।

মুখের ঘাঁ এর জন্য ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২ ও ভিটামিনন বি৬ এই তিনটি ভিটমিনের কম্বিরনশন একটি পাওডার পাওয়া যায় সেটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরো পড়ুন: গরুর পেট ফাঁপা রোগ, ঔষধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *