রাফেজ | গরুর আঁশযুক্ত খাদ্য ও এর শ্রেণীবিভাগ

রাফেজ গরুর আঁশযুক্ত খাদ্য ও এর শ্রেণীবিভাগ

রাফেজ | গরুর আঁশযুক্ত খাদ্য ও এর শ্রেণীবিভাগ।গবাদিপশুর আঁষ বা ফাইবার জাতীয় খাবার কেই মুলত ইংরেজিতে রাফেজ বলা হয়। রুমিনান্ট তথা যাবরকাটা প্রাণীদের খাদ্যে ৬০% বা আঁস থাকা জরুরী। আমরা আমাদের খামারের প্রাণীদের আঁস জাতীয় খাদ্য হিসাবে কোনটি ব্যবহার করব এবং কোন কোন রাফেজের পুষ্টিগুণ কেমন তা জানা থাকলে আমরা কম খরচে খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারব।

আমরা শুধু খড় বা বিছলির পিছনে ছুটছি। কিন্তু আমরা খুব সহজেই আঁশ যুক্ত খদ্য সরবরাহ করতে পারি।

রাফেজ কী

গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয় এমন আঁশযুক্ত খাদ্য কে রাফেজ বলে। যেমন ঘাস, সাইলেজ, খড়, সজিনা বা অন্যান্য গাছের পাতা, বিভিন্ন শস্যকণার আবরণ যা গবাদিপশু খেতে পারে ইত্যাদি। আঁশ জাতীয় খাদ্য এ রুমেন ডাইজেস্টেবল ফাইবার বা আঁশ থাকে।

গরু বা ছাগল কে রোমন্থ্য জাবর কাটা প্রাণি বলা হয়। আর জাবর কাটা প্রণির জন্য রাফেজ বা ফাইবার যুক্ত খাদ্য খুব দরকার।

গরুর খাদ্যে পর্যাপ্ত ফাইবার না থাকলে সেই খাদ্য হজমে সমস্যা হয়। এবং গরুর হজম ক্রিয়ায় প্রচন্ড প্রভাব পড়ে। ফলে গরু খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়।

শ্রেণীবিভাগ

গরুর খাদ্য তালিকার যেগুলো মুলত আঁশ বা ফাইবার জাতীয় খাদ্য সেগুলোই আসলে রাফেজ। কিন্তু গরুর আঁশ জাতীয় খাবারের পরিধি বা বিস্তৃতি ব্যাপক। আর তায় এর শ্রেণীবিভাগ জানা দরকার। গরুর আঁশ জাতীয় খাদ্য কে মুলত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে-

  1. ড্রাই রাফেজ ও
  2. গ্রীন রাফেজ

ড্রাই রাফেজ

গবাদিপশুর শুকনো আঁশ জাতীয় খাবার কে ড্রাই রাফেজ বলে। বিভিন্য ধরনের ফসলের উচ্ছিস্ট ও সংগ্রিহীত অংশ যা শুকিয়ে সংগ্রহ করা হয় এমন গো খাদ্যই মুলত শুকনো আঁশ জাতীয় খাদ্য নামে পরিচিত। এধরনের আঁশ যুক্ত খাদ্য কে আমরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-

হে

  • লিগিউমিনাস হে– বারশিম, ছোলা, সয়াবিন,খেসারী ইত্যাদি লিগিউম জাতীয় গাছ দিয়ে যে ‘হে’ করা হয়ে থাকে সেগুলিকে লিগিউমিনাস হে বলা হয়ে থাকে।
  • নন লিগিউমিনাস হে– ওট,বার্লি,ঘাস ইত্যাদি দিয়ে যে হে করা হয় সেগুলিকে নন লিগিউমিনাস ‘হে’ বলা হয়ে থাকে।
  • মিক্সড হে- লিগিউমিনাস এবং নন লিগিউমিনাস গাছ বা ঘাস দিয়ে একত্রে যে ‘হে’ করা হয় সেগুলিকে মিক্সড ‘হে’ বলা হয়ে থাকে।

শস্যদানার আবরণ বা হাস্ক

সাধারণত চাল, ভুট্টা, বাদাম, ছোলা সহ সকল ডাল ও তেল জাতীয় শস্যদানার আবরণকে হাস্ক বা ভুসি বলে। এই হাস্ক বা ভুসি গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে এধরণের আঁশ জাতীয় খাদ্যর ব্যবহার কম বেশি হয়ে থাকে। গরুর কাছে এ খাবার খুবই সুসাধু। গমের ভুসি, খেসারি ডালের ভুসি সহ সকল ভু্িসিই কিন্তু গরুর জন্য ভালো খাদ্য। হাল্ক বা ভুসির মধ্যে গমের ভুসি ও সায়াবিন হাল্ক গরুর জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও অধীক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।

মোচা বা স্টোভার

ভুট্টা, সরগাম ইত্যাদি ফসলের মোচা গরুর একটি ভালো আঁশ জাতীয় খাবার। এগুলো থেকে বিভিন্ন দরকারি পুষ্টি সহ পর্যাপ্ত ডাইজেস্টেবল ফাইবার পাওয়া যায়। এবং মৌসুদে এগুলো খুবই সহজলভ্য হয়।

খড় বা স্ট্র

সাধারণত ধান সহ বিভিন্ন ঘাসের খর বা স্ট্র একটি আঁশ জাতীয় খাদ্যর বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ সহ সকল দেশে রাইচ স্ট্র (Rice Straw)সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু রাইচ স্ট্র থেকে পর্যাপ্ত ডাইজেস্টেবল ফাইবার পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়না অন্যান্ন পুষ্টি। আর তাই স্ট্র বা খড় কে উৎকৃষ্ট মানের আঁশ জাতীয় খাদ্য বলা যায় না। তবে খড় কে ইউরিয়া মোলাসেস ট্রিটমেন্ট দিয়ে এর পুষ্টিগুণ বহুগুণ বৃদ্ধি করা যায়। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশে খড় বা স্ট্র বা নাড়ার ব্যপক স্বল্পতা রয়েছে। আর তাই আমাদের অন্যান্য আঁশ জাতীয় খাদ্যের উপর জোর দিতে হবে।

সাইলেজ

কাঁচা ঘাস, ভুট্টা গাছ, গাছের পাতা ইত্যাদি গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত রূপই হলো সাইলেজ। সাইলেজ গরু-ছাগলের জন্য একটি উৎকৃষ্ট আঁশযুক্ত খাবার।

গ্রীন রাফেজ

গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে যে সকল কাঁচা আঁশ বা ফাইবার জাতীয় উদ্ভিদ সরবরাহ করা হয় সেগুলোকে গ্রীন রাফেজ বলে। এদের কে নিম্নোক্ত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

কাল্টিভেটেড বা চাষকরা ফডার

গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে চাষ করা বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন সজনে, ইপিল ইপিল, ধইঞ্চা ইত্যাদি গাছের পাতা, মিষ্টি আলু গাছ, ভুট্টা গাছ ইত্যাদি হচ্ছে কাল্টিভেটেড ফডার। বিভিন্ন ঋতূ অনুযায়ী এগুলি চাষ করা হয় এবং তা কাঁচা গবাদিপশুদের সরাসরি খাদ্য হিসাবে প্রদান করা হয়।

ঘাস

বিভিন্ন জাতের কাঁচা ঘাস যেমন পাকচং, ন্যাপিয়ার, জার্মান, সিগনাল, সুদান, ভুট্টা ইত্যাদি কাঁচা ঘাস গ্রীন আঁশ জাতীয় খাদ্যর একটি বড় উৎস। আমাদের বাংলাদেশে আঁশ জাতীয় খাদ্য হিসাবে কাঁচা ঘাসের ব্যবহার বেশি।

লিগিউমস

শিম, ছোলা, খেসারী, মাষ্কলাই ইত্যাদি লিগিউম জাতীয় গাছ বা উদ্ভিদ থেকে যে আঁশ জাতীয় খাদ্য সংগ্রহ করা হয় সেগুলোকে লিগিউমস রাফেজ বলে। আমাদের দেশে প্রচুর লিগিউমস ফসলের আবাদ থাকলেও আঁশ জাতীয় খাদ্য হিসাবে গবাদিপশু তে এর ব্যবহার খুবই কম।

রাফেজ
গরুর আঁশযুক্ত খাদ্য

উৎকৃষ্ট মানের রাফেজ কী?

উৎকৃষ্ট মানের রাফেজ যদি আমরা গবাদিপশুদের সরবরাহ করতে পারি তাহলে তাদের জন্য আর কন্সেন্ট্রেড ফিড বা দানাদার খাবারের প্রয়োজন তেমন হয় না। এতে আমরা সাশ্রয়ী ভাবে গবাদিপশু পালন করতে পারব।

  • উৎকৃষ্ট মানের রাফেজে কমপক্ষে ১৮% রুমেন ডাইজেস্টেবল ফাইবার বা হজমযোগ্য আঁশ থাকতে হবে।
  • উৎকৃষ্ট মানের আঁশ জাতীয় খাদ্য আমিষ, কার্বোহাইড্রেট, বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগ্নেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি সবকিছুই থাকতে হবে।
  • আঁশ জাতীয় খাদ্য ময়লা-মাটি মুক্ত হতে হবে।
  • আঁশ জাতীয় খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো রাখতে হবে।
  • আঁশ জাতীয় খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধিত এবং বিভিন্ন প্রকার পুষ্টিমান সম্পর্কিত ভালো ধারণা থাকতে হবে।

গবাদিপশু তে সরবরাহ

ড্রাই রাফেজ ০.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চির আকারে সরবরাহ করতে হবে। আকারটা এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো, এই আকারের আঁশ জাতীয় খাদ্য গবাদিপশু গ্রহন করলে তা পাকস্থলীর চারপাশে ম্যাটের মতো আবরণ সৃষ্টি করে যা মাইক্রোবিয়ালদের খাদ্য যথাযথ ভাবে হজম করা সহজ করে দেয়। কেম পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ যেমন খড় কে ট্রিটমেন্ট করে পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করে পশুকে সরবরাহ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

গ্রীন বা সবুজ আঁশ জাতীয় খাদ্য আকারে কিছুটা বড় হলেও কোন সমস্যা নেই। গবাদিপশুকে ড্রাই বা গ্রীন দুই ধরনের ই সরবরাহ করতে হবে। প্রাণীর মোট রাফেজের চাহিদার ৬০% গ্রীন ও ৪০ শুকনো দেওয়া যেতে পারে। ড্রাই আঁশ জাতীয় খাদ্য ময়েশ্চার থাকবে ১০%-১৫% এর মধ্যে। গ্রীন রাফেজে ময়েশ্চার থাকবে ৬০%-৯০% এর মধ্যে। এবং সাইলেজে ময়েশ্চার থাকবে ৬৫%-৭০%।

আমরা যদি এই মাধ্যমেই খামারের গবাদিপশুর খাদ্যে যথাযথ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ট্রেস মিনেরালস, ভিটামিনস ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে দানাদার খাদ্য বা কনসেনট্রেট ফিডের আরও প্রয়োজন কমে যাবে। এজন্য আমাদের রাফেজে থাকা উপাদানের পুষ্টিগুণ এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। এবং কম দাম উৎকৃষ্ট মানের ফাইবার যুক্ত গরুর খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। শুধু খড় বা স্ট্র এর উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না।

আর্টিকেল টি পড়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনার মতামত আমাদের কাছে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত করে আমাদের উৎসাহীত করুন।

আরো পড়ুন- গমের ভুষি, এর ব্যবহার ও দাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *