মলা মাছ চাষ যেমন সহজ তেমনি সম্ভাবনাময়। দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে মলা মাছ অন্যতম। এই মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি অত্যান্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ। মলা মাছে প্রচুর ভিটামিন এ থাকায় ডাক্তার সবসময় বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেয়। আমাদের দেশের খাল-বিল কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে এখন এই মাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না। মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে এখন বড় পরিসরে আবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মলা মাছের শ্রেণীবিন্যাস
প্রাণি বিজ্ঞানে এই প্রজাতির মাছের শ্রেণীবিন্যাস ও অবস্থান নিম্নরূপ-
কিংডম: অ্যানিমালিয়া (Animalia)
ফাইলাম: কোর্ডটা (Chordata)
ক্লাস: অ্যাক্টিনোপার্টিগেই (Actinopterygii)
অর্ডার: সাইপ্রিনিফর্মস (Cypriniformes)
পরিবার: সাইপ্রিনিডে (Cyprinidae)
জেনাস/বংশ: এম্বলিফ্যারিনগডন (Amblypharyngodon)
প্রজাতি: এম্বলিফ্যারিনগডন মলা (Amblypharyngodon mola)
মলা মাছ পরিচিতি
মাছের নাম | মলা (Mola carplet) |
মাছের বৈজ্ঞানিক নাম | এম্বলিফ্যারিনগডন মলা (Amblypharyngodon mola) |
প্রচলিত নাম | ময়া মাছ, মলু মাছ, ইত্যাদি। |
দৈহিক গঠন | শরীর মাঝারিভাবে সংকুচিত ও চ্যাপ্টা। পাতলা চামড়ায় আবৃত, কডাল গভীরভাবে কাঁটাযুক্ত। আকারে ছোট। রঙের রূপালী, একটি কালো দাগ মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত শরীরের উভয় পাশে দেখা যায়। এই প্রজাতি 20 সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য হয়। |
প্রাপ্তি স্থান | ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। |
জলাশয় | নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ও পুকুরের পানির বসবাস করে। |
রোগ | এই মাছের তেমন কোন বিশেষ রোগ নেই। পানি বাহিত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্ষতরোগ, পাখনা পচা, ফুলকা পচা, লেজ পচা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। |
খাদ্য | প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য হলো জুপ্লাংটন ও ফাইটোপ্লাংটন। পুকুরে মলা মাছ চাষ করছে বাড়তি খাবার দিতে হয়। |
উৎপাদন | এই মাছ দ্রুত বর্ধণশীল ও ব্যাপক প্রজননক্ষম হওয়ায় কম সময়ে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। |
প্রজনন | মলা মাছ প্রথম বছরেই প্রজননক্ষম হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে প্রজনন করে থাকে। বছরে কমপক্ষে ২-৩ বার ডিম ও বাচ্চা দেয়। |
বাজার দাম | এই মাছের বাজার মূল্য খুবই ভালো। বাজারে মলা মাছের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা প্রতি কেজি। |
স্বাদ ও পুষ্টি
মলা মাছ অত্যান্ত সুস্বাদু একটি দেশি জাতের মাছ। এই মাছের তরকাড়ি অমৃতের মত। মাছের যে কতটা স্বাদ হতে পারে তা মলা মাছের তরকারি না খেলে বোঝার উপায় নেই। পুষ্টির দিক থেকেও এই মাছ সেরা।
পানি | – |
প্রোটিন | ১৮.০ |
ফ্যাট | ৪.১ |
আয়রণ | ০.৪ |
ক্যালসিয়াম | ০.৫৫ |
ফসফরাস | ০.৩৫ |
কার্বোহায়ড্রেট | – |
ক্যালোরি | – |

মলা মাছ চাষ পদ্ধতি
মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বসবাস করে। দুষিত পানিতে এই মাছ দ্রুত মারাযেতে থাকে। কিছু সাব্ধানতা অবলম্বন করলে পুকুরে এই মাছ চাষ করা যায়। পুকুরে বা স্বচ্ছ জলাশয়ে মলা মাছের চাষ পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হলো।
পুকুর নির্বাচন
- পুকুর রৌদ্র ও আলোকিত খোলামেলা হাওয়া হতে হবে।
- পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা রাখা যাবে না।
- দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা রৌদ্রালোক নিশ্চিত করতে হবে।
- পুকুর আয়তকার হলে ভালো হয়।
- পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতক হওয়া উচিত।
- পুকুরের গড় গভীরতা ৩.৫-৪.৫ ফুট হওয়া উচিত।
- পুকুরে বছরে ন্যূনতম ৫-৬ মাস পানি থাকে এমন পুকুর নির্বাচন করতে হবে।
- পুকুরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- পুকুরের তলদেশ সমতল ও পঁচা কাদা মুক্ত হওয়া উচিত।
- বন্যামুক্ত ও বসতবাড়ীর আশে পাশে পুকুর নিতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতি
পুকুরে পানি দেওয়ার আগে পুকুরের সব পানি বের করে পুকুর শুকাতে হবে। পুকুরের পাড় মজবুত করে বাধতে হবে। মাটিতে চুন প্রয়োগ করে তারপর পানি প্রবেশ করাতে হবে।
মজুদ করণ
প্রাকৃতিক উৎস যেমন- খাল, বিল বা বড় পুকুর হতে মলার ব্রুড সংগ্রহ করে চাষের পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে। অথবা হ্যাচারী থেকে রেনু কিনে চাষ শুরু করা যেতে পারে। প্রতি শতকে ৪০০টি মাছ মজুদ করা যাবে। একবার ব্রুডার মাছ স্টক হলেই আর চিন্তা নেই। এক মাস পর থেকেই মাছ ডিম দিতে শুরু করবে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- খাবার হিসেবে শুধুমাত্র অটো-কুঁড়া বা রাইচ পালিশ পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে।
- মাছের দেহের মোট ওজনের ৫% হারে অটো পালিশ পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- অন্য খাবার ব্যবহার করলে পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। যা মাছের ক্ষতি সাধিত করে।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
- পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে।
- ১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।
- পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখতে প্রতি মাসে একবার পুকুরে জিওলাইট অথবা চুন দিতে হবে।
- মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- এক পুকুরের জাল অন্য পুকুরে ব্যবহারের আগে ভাল পানির সাথে জিবাণু নাশক পটাশ মিশিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- অনেক সময় বক, মাছরাঙা বা জলজ পাখি থেকে রোগ জীবাণুর ছড়ায় তাই এগুলোর যাতাওয়াত বন্ধ করতে হবে।
মাছ ধরা ও বাজারজাতকরণ
দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর মাছ আহরণ করা যেতে পারে। মাছ ধরার সময় এমন জাল ব্যবহার করা উচিত যাতে শুধু বড় মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়।
এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যেতে পারে। ৬ মাস পর পুকুরের পানি শুকিয়ে সমস্ত মাছ ধরে ফেলতে হবে।
আরো পড়ুন- মাছের খাদ্য তৈরি ও উপকরণ