দেশি মাগুর মাছ চাষ ও রেণু পোনা উৎপাদন পদ্ধতি

দেশি মাগুর মাছ

দেশি মাগুর মাছ চাষ ও রেণু পোনা উৎপাদন পদ্ধতি মৎস্য খামারিদের আগ্রহের বিষয় । এই মাছ একটি আতি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু প্রকৃতির মাছ। দেশি মাগুর মাছ চাষ বর্তমান সময়ে ব্যাপক জনপ্রীয় হয়ে উঠেছে। মাগুর মাছ চাষ করার পদ্ধতিও এখন সকল মাছ চাষীর জানা। দেশি মাগুর মাছের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এক সময় আমাদের দেশে এই মাছটি সহজেই প্রাকৃতিক জলাশয় ও খাল বিলে পাওয়া যেত।

কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশি মাগুর আর তেমন পাওয়া যায় না। বলতে গেলে মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। আশার কথা হলো আমাদের দেশের মাছ চাষিরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই মাগুর মাছটিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। দেশি মাগুর মাছের দাম তুলনামুলক অনেক বেশি থাকে সবসময়।

দেশি মাগুর মাছ চাষ করার পদ্ধতি

যে সব দেশীয় জাতের মাছ সহজে অন্য যে কোন মাছের সাথে মিশ্রভাবে চাষ করা যায়, তাদের মধ্যে মাগুর মাছ অন্যতম। স্বাদে ও পুষ্টিগুনে এই মাছ অতুলনীয়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় ১৯৮৯ সালে প্রথম আমাদের দেশে থাইল্যান্ড থেকে আফ্রিকান হাইব্রীড জাতের মাগুর

আমদানি করার পর থেকে আস্তে আস্তে দেশি মাগুর মাছ চাষ করার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিদেশি জাতের মাগুর যে কোন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে, এবং কম খরচে অধিক উৎপাদন করা যায় বলে চাষীরা আফ্রিকান এই মাগুরের চাষে ঝুঁকে পরছেন।

আমাদের সকলের এখন করনীয় আফ্রিকান মাগুরের চাষ থেকে বেরিয়ে এসে দেশি মাগুর মাছ চাষ করা।

দেশি মাগুর মাছ চাষ (মিশ্র পদ্ধতি)

কার্প মাছ, তেলাপিয়া মাছ, পাঙাশ মাছ, পাবদা-গুলসার সাথে শতকে ১৫-২০ টি করে দেশি মাগুর খুব সহজে চাষ করা যায়। শিংমাছ চাষের সাথে শতকে ১০০ টি করে দেশীয় জাতের মাগুর চাষ করা যায়। এটি মুলত পানির নীচু স্তরের মাছ। এরা কাঁদা থেকে বিভিন্ন পোঁকা-মাকড় খেয়ে থাকে। এ মাছের জন্য ৩০% সম্পূরক খাবার সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়।

এরা পুকুরের অনেক বিরুপ পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। পানির পরিবেশ ঠিক রাখতে পারলে এই মাছ সহজে কোন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়না। কেউ চাইলে মাগুরের একক চাষও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে শতকে ২০০-৩০০ টি করে মাগুরের পোনা দিতে পারেন।

মিশ্র পদ্ধতিতে মাগুর চাষে ৮-৯ মাসে প্রতিটি মাছ ১৫০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে দেখা যায়। আর একক চাষে ৬-৭ মাসে ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। মিশ্রচাষে মাগুর মাছের জন্য আলাদা কোন খাবার দিতে হয়না এবং আলাদা কোন পরিচর্যাও করতে হয়না। আমাদের দেশের অনেক হ্যাচারী তেই দেশীয় মাগুরের রেনু ও পোনা পাওয়া যায়।

দেশী মাগুর মাছের রেনু উৎপাদন পদ্ধতি

প্রতি শতাংশ পুকুরে ৫০-১০০ টি দেশি জাতের মাগুর মাছ মজুত করতে হবে। সাধারণত দেশি জাতের মাগুর এক বছরেই প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য সুস্থ সবল ও পেট ভর্তি ডিম দেখে স্ত্রী মাছ নির্বাচন করতে হবে। উন্নত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকেই মাগুর মাছ প্রজনন করানো যায়।

দেশি মাগুর মাছ চেনার উপায়

প্রজননের সময় পুরুষ ও স্ত্রী মাগুর মাছগুলো কে সহজেই সনাক্ত করা যায়। দেখা যায় স্ত্রী মাগুর মাছ একটু কালচে বর্ণের হয় এবং প্রজনন মৌসুমে এদের পেট ভর্তি ডিম থাকে। আর পুরুষ মাছের পেট স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে এবং পুরুষ মাগুর মাছের রং দেখতে হালকা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। দেশি মাগুর মাছ চাষ করতে এর চেনার উপায় জানতে হবে।

দেশি মাগুর মাছ চাষ

হরমোন প্রয়োগ পদ্ধতি

দেশি মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত মাগুর মাছকে ২টি হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয়। ২টি হরমোন ইঞ্জেকশন হলো পিটুইটারি গ্যান্ট বা পিজি আর এইচ.সি.জি.। পি.জি. দিয়ে একটি মাত্র ডোজ দিয়ে ডিম সংগ্রহ করা যায় আবার ২টি ডোজ দিয়েও ডিম সংগ্রহ করা যায়। মাগুরের ডিম সংগ্রহের ক্ষেত্রে হরমোন ইঞ্জেকশনের চেয়ে মাছের পরিপক্কতার উপর বেশি নজর দেয়া উচিৎ।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় মাগুর মাছের ডিম পরিপক্ক থাকলে প্রতি কেজিতে ১৫ মিঃ গ্রাঃ পিজি ইনজেকশন দিয়েই ডিম সংগ্রহ করা যায় যদিও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি কেজিতে ১২০ মিঃ গ্রাঃ পিজি দেওয়ার নিয়ম। আর তাই আমাদেরকে মাছের হরমোন ইঞ্জেকশনের মাত্রার চেয়ে মাছের পরিপক্কতার উপর বেশি নজর দিতে হয়। যেহেতু শুধু ১৫-২০ মিঃ গ্রাঃ/ কেজি পিজি দিলেয় মাগুর মাছ ভাল ডিম দেয় সেখানে ১২০ মিঃ গ্রাঃ পিজি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

অনেক সময় দেখা যায় যে, মাছের পিজির মাত্রা বেশি হলে রেনু ভাল হয় না। আবার রেনু হলেও সেই রেনুর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকে। যে কারণে ব্যাপক রেনু উৎপাদন হলেও পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে পোনা উৎপাদন হয় না। এ গেল পিজি দ্রবনের কথা। এইচ.সি.জি. দিয়েও মাগুরের ইঞ্জেকশন করা যায়।

ইঞ্জেকশনের মাত্রা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পিজি ইঞ্জেকশন দিয়ে ২টি পদ্ধতিতে ডোজ দেয়া যায়। আমাদের মতে ২টি ডোজের মাধ্যমে দেশি মাগুরের ডিম সংগ্রহ করা হলে সবচেয়ে ভাল উৎপাদন বা ফলাফল পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ হবে ৫ মিগ্রা/কেজি এবং প্রথম ডোজের ৭/৮ ঘণ্টা পর ২য় ডোজ দিতে হবে প্রতি কেজিতে ১৫ মিলিগ্রাম হারে। ইঞ্জেকশন দিতে হবে প্রজনন অঙ্গ বরাবর উপরের মাংশল স্থানে। সাধারণত ২য় ডোজের ২০/২৪ ঘণ্টা পর দেশি মাগুর মাছের ডিম সংগ্রহের সময় হয়ে থাকে।

মাগুর মাছের ডিম সংগ্রহ পদ্ধতি

সাধারণত হাত দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মাগুর মাছের ডিম সংগ্রহ করতে হয়। প্রাকৃতিক উপায়ের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত এই মাছের প্রজনন করানো সম্ভব হয়নি। অন্যান্য কার্প মাছ যেখানে ডিম পাড়ার সময় হলে আপনা আপনি ডিম বের হতে থাকে, সেখানে মাগুরের ডিম সহজে বের হতে চায় না। আর তাই মাগুর মাছের ডিম বের করার সময় কার্প জাতীয় মাছের চেয়ে এর পেটে একটু বেশি জোরে চাপ প্রয়োগ করতে হয়। বেশি জোড়ে চাপ প্রয়োগের ফলে ডিম যেন ফেটে না যায় সে দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। তা না হলে তাতে সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতে পারে।

মাছের ডিম সংগ্রহ করে স্পার্ম মেশানো হয়। পুরুষ মাগুর মাছের টেস্টিজ বা অণ্ডকোষ কেটে স্পার্ম বের করে পাখির পালক দিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। প্রথমে হরমোন দিয়ে স্ত্রী মাগুরের পেটে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ডিম সংগ্রহ করতে হবে এবং একই সময়ে পুরুষ মাছের অণ্ডকোষ কেটে স্পার্ম বের করতে হবে।

কেননা আগে ডিম সংগ্রহ করে তারপর স্পার্ম সংগ্রহ করতে গেলে এতে সময় বেশি লাগে। পরে স্পার্ম মেশালে ডিমের উর্বতার হার কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি কোন কোন সময় দেখা যায় ডিম ফার্টিলাইজ হয় না। এখানে ১ থেকে ১.৫ মিনিটের মধ্যেই এই কাজটি শেষ করতে হয়।

ডিম সংগ্রহের পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

মাগুর মাছের ডিম সংগ্রহের পর ডিমগুলোকে সিস্টার্নে নিয়ে যেতে হবে। সিস্টার্নের আকার আয়তকার অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে ৮ ফুট এবং প্রস্থে ৪ ফুট হলে ভাল। সিস্টার্নের পানির উচ্চতা ৩ ইঞ্চির বেশি দেয়া যাবে না। ডিমগুলোকে সাবধানতার সাথে পাখির পালক দিয়ে আস্তে আস্তে সিস্টার্নে বিছিয়ে দিতে হয়। মাগুরের ডিম আঠালো প্রকৃতির হয়। আর সেজন্য ডিমগুলোকে এমনভাবে বিছাতে হবে যেন একটি ডিম আরেকটি ডিমের সাথে লেগে থাকতে না পারে। দেশি জাতের মাগুর মাছের ডিম ফুটতে কার্প জাতীয় মাছের চেয়ে সময় একটু বেশি লাগে।

দেশি জাতের মাগুর মাছের ডিম ফুটতে তাপমাত্রা ভেদে ৩০ থেকে ৩৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এই র্দীঘ সময়ে মাছের ডিমে ফাঙ্গাস বা ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে। সংগ্রিহীত এই ডিমে ফাঙ্গাস আক্রমণ করার সাথে সাথে সিস্টার্ন থেকে সাইফনের মাধ্যমে ফেলে দিতে হবে। তাছাড়া অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এই ফাঙ্গাস এক ডিম হতে অন্য ডিমে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ডিমকে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আর তাই ডিমগুলোকে সিস্টার্নে ঘন করে দেয়া যাবে না। যথাসম্ভব পাতলা করে বিছিয়ে দিতে হবে। এই সময় সার্বক্ষণিক ঠাণ্ডা পানির ঝর্ণার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পানির তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট রাখতে হয়।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে পানির তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট এর বেশি হলে দেশি মাগুরের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েও পরে বাচ্চা মারা যায়। এভাবে ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর বাচ্চাগুলো আপনা আপনি সিস্টার্নের কোণায় যেতে থাকবে। সিস্টার্নের কোণায় অবস্থান নিলেই সাধারণত বাচ্চার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো কোণায় অবস্থান নিলে সিস্টার্নের মাঝখানের ময়লা, ধূলাবালি সাইফনের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিতে হবে।

এভাবে উৎপাদিত মাগুর মাছের বাচ্চার বয়স ৭২ ঘণ্টা পার হলেই এদেরকে কৃত্রিম খাবার দিতে হবে। এই সময় খাদ্য হিসাবে ছোট ছোট জু-প্যাংকটন জীবিত অবস্থায় সিস্টার্নে দিতে হবে।

এই সকল জু-প্যাংকটন পুকুর থেকে জীবিত অবস্থায় ধরে সংগ্রহ করে তারপর সিস্টার্নে দিতে হবে। সিস্টার্নে দুই দিন এই খাবার খাওয়ানোর পর নার্সারি পুকুরে নার্ছিং করার জন্য স্থানান্তর করতে হবে।

দেশী মাগুর মাছের রেনু উৎপাদনকালীন সতর্কতা

  1. দেশি মাগুরের ব্রুড মাছ অবশ্যই পরিপক্ক হতে হবে। অন্যথায় সমস্ত কাজই বিফলে চলে যাবে।
  2. চাপ প্রয়োগ করে ডিম সংগ্রহের সময় খুব বেশি জোরে চাপ দিয়ে ডিম বের করা উচিৎ নয়। তাতে ডিম ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  3. সিস্টার্নে সংগ্রিহীত ডিম যেন অধিক ঘনত্বে দেয়া না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। অর্থাৎ একটি ডিম আরেকটি ডিমের সাথে যেন লেগে থাকে।
  4. সিস্টার্নের ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। পানির তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের বেশি হলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেও মারা যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে।

এভাবে চাহিদা অনুযায়ী যে কেউ দেশি মাগুরের রেনু উৎপাদন করতে পারেন।

দেশি মাগুরের পোনা কীভাবে উৎপাদন করতে হয়

পুকুর নির্বাচন

দেশি মাগুরের পোনা উৎপাদনের জন্য তলা শুকানো সাধারণত ১৫-২০ শতাংশের আয়তাকার পুকুর হলে ভাল হয়। প্রজনন মৌসুমের আগেই পুকুর শুকিয়ে যায় এমন পুকুর নির্বাচন করতে হবে। পুকুরের তলা ৮-১০ ইঞ্চি বা তারচেও বেশি ঢালু হওয়া দরকার।

পুকুর তৈরী

দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুকুর তৈরিতে কোনো ত্রুটি বা ভুল থাকলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন বা ফল পাওয়া যাবে না।

পুকুরের তলায় পানি থাকলে প্রথমেই তা সেচে ফেলতে হবে। এরপর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর রোদে শুকিয়ে পুকুরের চারপাশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

পুকুরের পাড়ে শক্ত জাল দিয়ে ভালভাবে বেড়া দিতে হবে। মাটি থেকে এ নেট বা জালের উচ্চতা হবে কমপক্ষে চার ফুটের। স্যালো মেশিন দিয়ে ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুট পরিষ্কার পানিত পুকুরে ঢুকাতে হবে।

দেশি মাগুর মাছ
দেশি মাগুর মাছ

পুকুরে পানি ভর্তি করা

এসময় একটি কথা অবশ্যই সকলকে মনে রাখতে হবে, অপরিষ্কার পানি কিছুতেই পুকুরে প্রবেশ করানো যাবে না এবং ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুটের বেশি পানিও দেয়া যাবে না। অনেক মৎস্য খামারি ২-৩ ফুট পানির মধ্যে রেনু ছাড়েন। এতে দশ ভাগের একভাগ পোনাও তারা উৎপাদন করতে পারে না। এটি হয় শুধুমাত্র পানির উচ্চতার কারণে।

দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদন করতে নার্সারি পুকুরের পানির উচ্চতা ১ ফুট বা তার চেয়ে কম হলে সবচেয়ে ভাল উৎপাদন হয়। আর পানির উচ্চতা যদি বেশি হয়, মাগুর মাছের পোনা ১-১.৫ ইঞ্চি সাইজ হওয়ার পর চিকন হতে থাকে এবং মাথা পানিতে লম্বালম্বিভাবে খাড়া করে দিয়ে স্থির থাকতে দেকা যায়। পরবর্তীতে দেখা যায় মাছের পোনা ব্যাপকহারে মারা যায়।

অনেক খামারিরা একে মাগুর মাছের রোগ মনে করে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষুধ প্রয়োগ করে তাকে। কিন্তু এতে করে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর প্রধান কারণ দেশি মাগুর মাছ বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। আর তাই বারবার বেশি পানির উচ্চতায় এসে অক্সিজেন নিতে গিয়ে মাছের কায়িক পরিশ্রম বেশি হয়, এতে এক সময় মাছ খুব দুর্বল হয়ে খাবার ছেড়ে দেয় এবং পরবর্তীতে মাগুর মাছের পোনাগুলো মারা যায়। এ ঘটনা বেশির ভাগ ঘটে সাধারণত রেনু ছাড়ার প্রথম এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে।

পানির পরিমান

দেশী মাগুরের রেনুর সাইজ যখন এক ইঞ্চি বা তারচেয়ে একটু বড় হয় তখন অনেকে ভাবতে পারেন কম পানিতে দেশি মাগুর বাঁচাবে কিনা? এর উত্তর হলো, আমাদের দেশে মে, জুন ও জুলাই মাসে মাগুরের পোনা উৎপাদনের সময় রোদের তাপমাত্রা এত বেশি থাকে যে পুকুরের তলা পর্যন্ত সূর্যের তাপে গরম হয়ে যায়। এ সময়ে দু’টি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

  1. পুকুরের এক পাশের পানির উচ্চতা আরেক পাশের চেয়ে ১ ফুটের বেশি বা ঢালু রাখতে হয়। অর্থাৎ এ পাশের পানির উচ্চতা ১ ফুট হলে অন্যপাশের উচ্চতা হবে প্রায় ২ ফুট থাকে। এতে প্রচন্ড রোদ্রের সময় দেশি মাগুরের রেনু গরম থেকে বাঁচার জন্য নিজে নিজেই পুকুরের গভীর অংশে চলে যায়। আবার রাতে তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে কম পানির উচ্চতায় রেনু পোনা চলে আসবে।
  2. কচুরীপানা দিয়েও পুকুরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুকুরের ৪-৫টি জায়গায় কচুরীপানা দিয়ে ৫ ফুট ব্যাসের বৃত্তাকার শেড তৈরি করতে হবে।

দেশি মাগুর মাছের খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি

মাগুর মাছের নার্সারি পুকুরে রেনু ছাড়ার পর খাদ্য হিসেবে সাধারণত ডিমের কুসুম ও গমের আটা মিশিয়ে খাবার হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়। মাগুর মাছের খাদ্য তালিকা- এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পুকুরের জন্য ২০ টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করার পর তা পানি ও ব্লেন্ডারের সাহায্যে ব্লিন্ড করতে হবে। এবং তা কাপড় দিয়ে ছেকে নিতে হবে। এরপর ফুটন্ত পানি চুলা থেকে নামিয়ে ওই পাতিলে ১ কেজি পরিমান গমের আটা মিশিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া করে দিতে হবে।

এখানে খেয়াল রাখতে হবে যেন আটা পাতিলের তলায় লেগে বা জমে না থাকে। আটা পাতিলের তলায় লেগে এবং তা পুড়ে গেলে এটি মাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আটা গরম পানির সাথে ভালভাবে মেশানোর পর টিওবওয়েলের পরিষ্কার পানি মিশিয়ে তা ভালোভাবে ঠান্ডা করতে হবে।

তারপর পানিতে মেশানো ডিমের কুসুমের সাথে আটা মেশানো পানি এক করে গুলিয়ে মাগুর মাছর খাবার হিসেবে পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। সন্ধ্যার পর একবার, রাত ১২ টার সময় একবার এবং ভোরে একবার। এভাবে মোট ৩ বার পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। দিনের বেলায় মাগুর মাছের পোনা খেতে চায় না তািই দিনে খাবার না দেয়াই ভাল। এভাবে ৫-৬ দিন খাবার দেয়ার পর ৬ দিন পর থেকে কৈ মাছের নার্সারি ফিড মাগুরকে দেয়া যেতে পারে। ৩০ দিনের মধ্যেই প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের পোনা হয়ে গেলে চাষের পুকুরে পোনা স্থানান্তরিত করতে হবে।

একজন মাছ চাষীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা

১৯৯৭ সালের শেষের দিকের কথা বলছি। একজন মাছ চাষীর ইচ্ছা হলো দেশি জাতের মাগুরের পোনা উৎপাদন করবে। তিনি বিভিন্ন হাওর-বাঁওড় থেকে হাজার তিনেক দেশি জাতের মাগুর সংগ্রহ করলেন। শুনেছিলেন দেশি মাগুর মাছ পুকুরে থাকতে চাই না, বর্ষাকালে পুকুর থেকে বের হয়ে যায়।

আর তাই মাগুর মাছের জন্য ৫ শতাংশ জায়গায়র চারদিকে মজবুত দেয়াল দিয়ে পাকা পুকুর তৈরি করলেন। এবং সেখানে ব্রুড মাগুর মাছগুলো রাখা হয়। বদ্ধ জায়গাযয়ে মাছগুলো এক সময় না খেয়ে মারা যেতে থাকে। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মাছগুলোকে এখন থেকে তুলে পুকুরে রাখবে। এবং তখনি মাছগুলো পুকুরে মজুত শুরু করলেন।

সেখানেও মাছ মারা যেতে থাকে। তার পরেও তিনি দমে যায়নি। আবারো নতুন করে মাগুর মাছ চাষ করা শুরু করলেন। এবার তিনি বিভিন্ন হাওর-বাঁওড় থেকে মাগুর মাছ কিনে ২ ফুট পানিতে মজুত করতে লাগলেন। এবার তিনি অনবরত পুকুরে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করে। একদিকে পরিষকার পানি ঢুকে আর অন্য দিক দিয়ে আগের পানি বেরিয়ে যায়। এতে পানির স্রোতের সৃষ্টি হয়। সেই স্রোতে মাগুর মাছগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায়। এবং মাছের মৃত্যুহারও অনেক কমে যায়।

দেশি মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি
দেশি মাগুর মাছ চাষ

মাগুর মাছের খাবার

এবার তিনি প্রযুক্তি পেয়ে গেলেন। এভাবে মাগুর মাছের মজুদ শেষ করেছেন কিন্তু কোনোভাবেই কৃত্রিম খাবারে অভ্যস্ত করতে পারছিলেন না। খাবার না খাওয়ার ফলে পানি দ্রুত নষ্ট হতে থাকে এবং তিনি বারবার পানি পরিবর্তন করতে থাকে। অবশেষে কিছু কাঁচা চিংড়ি একটি ছোট ট্রেতে দিয়ে পুকুরে রাখেন। ২দিন পর ট্রে উঠিয়ে দেখেন মাগুর মাছ তা খায়নি। আবার বাজার থেকে কাঁচা চিংড়ি কিনে এনে ট্রেতে করে পুকুরে দেয়। দুই দিন পর আবারো পরীক্ষা করে দেখেন চিংড়ি মাছ খেল কিনা। এবার মন হয় কিছু চিংড়ি খেয়েছে।

এভাবে কয়েকবার নতুন চিংড়ি দেয়াতে খেতে শুরু করল মাগুর মাছ। এরপর তিনি শুরু করেন আরেক কৌশল। একদিন পর পর বাজার থেকে চিংড়ি এনে পুকুরে মাগুর মাছের খাবার হিসাবে দিতে থাকেন। মাগুর মাছও খেতে থাকে। কিন্তু এত কাঁচা চিংড়ির যোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক তার মাগুর মাছকে স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত করাতে হবে। আর তাই কাঁচা চিংড়ির সাথে শুকনো চিংড়ি দেয়া হয়, তাও খেল।

এরপর দেয়া হল শুধু শুকনো চিংড়ি, তাও খেল। এরপর যা করলেন, শুকনো চিংড়ির পাউডারের সাথে অল্প পরিমাণে খইল, ভূষি ইত্যাদি দিয়ে মিশ্রণ করে ছোট ছোট বল বানিয়ে খেতে দেয়া হলে তাতেও অভ্যস্ত হয়ে যায়। এভাবেই হাওর-বাঁওড়ের দেশি মাগুরকে স্বাভাবিক খাবারে সাথে অভ্যস্ত করা হয়। এর কিছুদিন পরেই মাছগুলো বড় হয়ে পেট ভরে গেল ডিমে। এবাবেই দেশি মাগুর মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদন শুরু হয়।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে দেশি মাগুর মাছ চাষ

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ একটি আধুনিক প্রযুক্তি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে দেশি মাগুর মাছ চাষ করা খুবই সহজ পদ্ধতি। এই মাছ খুবই কষ্ট সহিন্সু, রোগ প্রতিরোধী ও দাম বেশি হওয়ায় বায়োফ্লকে এই মাছ আমাদের দেশে ব্যাপক চাষ হচ্ছে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে দেশী মাগুর মাছ চাষের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয় নজরে রাখতে হবে-

  • বিস্যস্ত হ্যাচারী থেকে ভালোমানের পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
  • পোনা পরিবহন খুব সাবধানে করতে হবে যেন এক মাছের কাটা থেকে অন্য মাছ আঘাত প্রাপ্ত না হয়।
  • বায়োফ্লক সিস্টেম উত্তম রুপে জীবাণু মুক্ত করতে হবে।

দেশি মাগুর মাছ চাষ ও রেণু উৎপাদন pdf বই

মাগুর মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

  • মাগুর মাছের খাবার
  • দেশি মাগুর মাছ চেনার উপায়
  • দেশি মাগুর মাছ চাষ
  • বিদেশি মাগুর মাছ চাষ
  • মাগুর মাছের খাদ্য তালিকা
  • দেশি মাগুর মাছের দাম
  • মাগুর মাছের মিশ্র চাষ
  • দেশি মাগুর মাছ চাষ করার পদ্ধতি

দেশি মাগুর মাছ চাষ একটি নতুন প্রযুক্তি। সর্বপ্রথম ময়মনসিংহে এই মাছের বানিজ্যিক চাষ ও রেণু পোনা উৎপাদন সুরু হয়। বর্তমানে দেশি মাগুর মাছ চাষ সারাদেশে ছরিয়ে পরেছে। এখন গ্রাম গন্জে ছোট ছোট মৎস্য খামারেও দেশি মাগুর মাছ চাষ ছড়িয়ে পরেছে। বাজারে ভালো দাম থাকায় মাছ চাষে সকলের আগ্রহও অনেক বেশি। আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার মাধ্যমে আগামী দিনে দেশি মাগুর মাছ চাষ আরো ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পরবে বলে আমার বিশ্বাস।

আরো পড়ুন: মাছ ও চিংড়ি চাষে প্রোবায়োটিক এর ব্যবহার

2 thoughts on “দেশি মাগুর মাছ চাষ ও রেণু পোনা উৎপাদন পদ্ধতি”

  1. I think the admin of this web page is genuinely working hard for his site, for the reason that here every information is quality based information. Merry Lewiss Anita

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *