টার্কি মুরগি

টার্কি মুরগি

টার্কি মুরগি আমেরিকার জনপ্রিয় মাংস উৎপাদন কারি পোল্ট্রি। 1792 সালের পূর্বে এশিয়া এবং ইউরোপিয়ানদের নিকট টার্কি মুরগি (turkey hen) সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। 1498 সালে মেক্সিকোতে সর্বপ্রথম বন্য অবস্থা থেকে টার্কিকে গৃহপালিতকরণ করা হয়। 1573 সালে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে এই মুরগির বিস্তার শুরু হয়।

বর্তমানে ইউরোপ জুড়ে বিস্তার লক্ষ করা যায়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়াতে টার্কির ব্যাপক বিস্তার দেখা যায়। আমাদের দেশে টার্কি উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ টার্কিকে টম এবং স্ত্রী টার্কিকে হেল এবং বাচ্চাকে পোল্ট বলে।

টার্কি মুরগির জাত ও উপজাতি

বর্তমানে আদর্শ প্রজননের মাধ্যমে কয়েক ধরনের উপজাতি তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

  1. ব্রোঞ্জ (Bronze)
  2. ন্যারেনজেনসেট (Narrangansett)
  3. সাদা হল্যান্ড (White Holland)
  4. বারবন রেড (Bourbon Red)
  5. কালো (Black)
  6. শ্লেট (Slate) এবং
  7. বেল্টসভিল হোয়াইট (Beltsville White)

ব্রোঞ্জ উপজাতের টার্কি মুরগি

এরা দেখতে বিবর্ণ মেটে রঙের। মিসিসিপি উপত্যকা এবং আমেরিকার পূর্বাঞ্চলের বন্য টার্কির সাথে এদের রংয়ের সামঞ্জস্য রয়েছে।

লেজ এবং পাখার প্রান্তভাগে সাদা চিহ্ন বিদ্যমান থাকায় এদেরকে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়। শরীরের পালকে তামাটে ব্রোঞ্জ রং এর চিহ্ন বিদ্যমান থাকে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিউ ইংল্যান্ড ওয়াইল্ড টার্কির সাথে গৃহপালিত টার্কির সংকরায়নের ফলে বর্তমান জনপ্রিয় ব্রোঞ্জ টার্কি মুরগির সৃষ্টি হয়েছে।

  • প্রাপ্তবয়স্ক ব্রোঞ্জ টমের ওজন- 16.5 কেজি
  • প্রাপ্তবয়স্ক ব্রোঞ্জ হেনের ওজন- 9.1 0 কেজি
  • এক বৎসর বয়সী ব্রোঞ্জ টমের ওজন- 15 কেজি
  • এক বছর বয়সী ব্রোঞ্জ হেনের ওজন- 8 কেজি

প্রতিটি ব্রোঞ্জ হেন বছরে 40 থেকে 80 টি ডিম দিয়ে থাকে।

ন্যারেনজেনসেট উপজাতের টার্কি মুরগি

এদের উৎপত্তি ন্যারেনজেনসেট সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায়। ইংরেজ বসতি স্থাপনকারীদের মাধ্যমে আনীত নরফক ব্ল্যাক এবং নিউ ইংল্যান্ড ওয়াইল্ড উপজাতের সংকরায়নের ফলে উদ্ভূত উপজাতের সাথে মেক্সিকান ওয়ইল্ড প্রজাতির টার্কির প্রজননের মাধ্যমে এই উপজাত সৃষ্টি হয়েছে। এদের আকার-আকৃতি অনেকটা ব্রোঞ্জ টার্কির মতই। তবে ব্রোঞ্জ এর পালকে যেমন তামাটে ব্রঞ্চ রং এর চিহ্ন থাকে ন্যারেনজেনসেট টার্কিতে থাকে না এবং পালক হালকা বাদামী দাগ যুক্ত হয়ে থাকে।

  • প্রাপ্তবয়স্ক টমের ওজন- 15 কেজি
  • প্রাপ্তবয়স্ক হেনের ওজন- 8 কেজি
  • এক বৎসর বয়সী মেয়ের ওজন- 13.5 কেজি
  • এক বছর বয়সি হেনের ওজন- 7.5 কেজি
টার্কি মুরগি
ব্রোঞ্জ উপজাতের টার্কি

হোয়াইট হল্যান্ড উপ-জাত

এদের উৎপত্তিস্থল নেদারল্যান্ডে। পালকের রং ধবধবে সাদা। পায়ের উপরের পালক হালকা গোলাপী হয়ে থাকে। ডাচ বসতি স্থাপনকারীরা নেদারল্যান্ড থেকে সাদা রঙের টার্কি আমেরিকাতে নিয়ে আসে। নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে আমেরিকাতে উপজাতি বিকাশ লাভ করে।

  • প্রাপ্তবয়স্ক টমের ওজন- 15 কেজি
  • প্রাপ্তবয়স্ক হেন এর ওজন- 8 কেজি
  • এক বৎসর বয়সী টমের ওজন- 13.5 কেজি
  • এক বছর বয়সী হেনের ওজন- 7.7 কেজি

বেল্টসভিল উপ-জাত

এরা ছোট আকারের টার্কি মুরগি। বেল্টসভিল রিসার্চ সেন্টারের ইউ. এস. ডি. এ-এর একদল গবেষণা কর্মীরা এ উপ জাতি সৃষ্টি করেন। আকারে ছোট বিধায় এদেরকে স্মল হোয়াইট বলা হয়ে থাকে। ব্রয়লার রোস্টারে জন্য এটি বেশ জনপ্রিয়। এদের পালকের রং সাদা এবং পায়ের উপরের পালক গোলাপী হয়ে থাকে।

  • প্রাপ্তবয়স্ক টমের ওজন- 8.15 থেকে 10 কেজি
  • প্রাপ্ত বয়স্ক হেনের ওজন- 4.5 থেকে 5.5 কেজি
  • এক বৎসর বয়সের টমের ওজন- 5.5 থেকে 7.7 কেজি
  • এক বছর বয়সি হেনের ওজন- 3.4.5 কেজি

ডিম উৎপাদন

অধিক হারে উর্বর ডিম উৎপাদনের উপর সফল টার্কি পালন নির্ভর করে। টার্কির ডিম উৎপাদনের হার খুবই কম। কম বয়সি হেন বয়স্ক হেন অপেক্ষা অধিক ডিম দেয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে টার্কির ডিম উৎপাদনের রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে টার্কি মুরগি প্রথম বছর 77 টি, দ্বিতীয় বছর 50 টি, তৃতীয় বৎসর 44 টি এবং পঞ্চম বছর 28 টি ডিম দেয়।

ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সময় এর উপর ডিম দেওয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

যেসব বাচ্চা কম সময়ে ফুটে বের হয়েছে তারা শীতকাল পর্যন্ত ডিম দেয় এবং যেসব বাচ্চা বেশি সময়ে ফুটে বের হয় তারা প্রায় বসন্তকাল পর্যন্ত ডিম দেয়।

কৃত্রিম প্রজনন

প্রাকৃতিক প্রজনন এর চেয়ে কৃত্রিম প্রজনন দিয়ে টার্কি মুরগির ডিমের উর্বরতা হার বাড়ানো হয়।

টার্কি মুরগির প্রজনন দলের বৈশিষ্ট্য

যে কোন প্রজনন কর্মসূচির সফলতা নির্ভর করে প্রজনন দলের যোগ্যতার উপর। সতর্কতার সাথে প্রজনন দল নির্বাচন সফলতার পূর্ব শর্ত। আমেরিকার টার্কি ড্রাগন প্রজননের উদ্দেশ্যে তার কি নির্বাচনের জন্য কিছু নীতিমালা সুপারিশ করেছে যা অনুসরণ করা প্রয়োজন।

হোয়াইট হল্যান্ড টার্কি মুরগি
হোয়াইট হল্যান্ড টার্কি

টার্কি মুরগির খাদ্য ও পুষ্টি

হাঁস-মুরগি ও পোল্ট্রির অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে টার্কির পুষ্টির যথেষ্ট ব্যতিক্রমধর্মী। বাচ্চার বৃদ্ধির হার পোল্ট্রির অন্যান্য প্রজাতির বাচ্চার চেয়ে অনেক বেশি। তাই বাড়ন্ত অবস্থায় এদের খাদ্যের প্রোটিনের পরিমান খুবই বেশি দিতে হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক টার্কিতে প্রোটিনের পরিমাণ কম প্রয়োজন হয়।

পোল্ট্রির অন্যান্য প্রজাতির পুষ্টির চেয়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কোন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে অভাবজনিত লক্ষণ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়।  প্রথম চার সপ্তাহ পর্যন্ত টার্কির রেশনে 28 থেকে 26 শতাংশ প্রোটিন থাকা উচিত। 4 থেকে 8 সপ্তাহ 23 শতাংশ প্রোটিন থাকা উচিত। আট সপ্তাহ থেকে 12 সপ্তাহের 21.5 পার্সেন্ট প্রোটিন থাকা দরকার এবং 12 থেকে 25 সপ্তাহের 18% ও 15 থেকে 20 সপ্তাহে 16 পার্সেন্ট প্রোটিন দেওয়া উচিত।

প্রোটিনের উৎস হিসেবে মিট এন্ড বোন মিল,  সয়াবিন মিল বিভিন্ন ধরনের আমিষ যুক্ত প্রোটিন কনসেনট্রেট ব্যবহৃত করা যেতে পারে। অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড, আবশ্যকীয় খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন, পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে স্ত্রী টার্কি মুরগি পুরুষ টার্কি মুরগির তুলনায় প্রোটিনের পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়।

টার্কি মুরগির খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ

টার্কি প্রথম চার সপ্তাহ বয়সে দৈনিক গড়ে 30 গ্রাম করে খাদ্য গ্রহণ করে। 30 সপ্তাহ বয়সে এদের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ দৈনিক 300 গ্রাম। টার্কি মুরগি বেশ দক্ষতার সাথে খাদ্য রূপান্তরিত করতে পারে। শূন্য থেকে 12 সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে বাচ্চা প্রতি কেজি ওজন বৃদ্ধির জন্য 2 থেকে 2.5 কেজি খাদ্য গ্রহণ করে। তিন মাস বয়সের পর থেকে এদের দৈহিক বর্ধনের হার কমে যায়। সপ্তম মাসে প্রতিটি প্রার্থী প্রায় 3 দশমিক 5 কেজি ওজন প্রাপ্ত হয়। অষ্টম মাসে ওজন প্রায় পাঁচ কেজি হয়।

টার্কি মুরগির রোগ

বাড়ন্ত টার্কি মুরগি এবং প্রজনন দলে মৃত্যুজনিত কারণে লাভজনক টার্কি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন রোগ ব্যাধির ফলে তার মৃত্যু ঘটে থাকে

কালোমাথা রোগ

কালোমাথা বা ব্ল্যাক হেডস টার্কির একটি মারাত্মক রোগ। এক ধরনের প্রোটোজোয়া এই রোগের কারণ। এ জীবাণু টার্কির সিকাতে অবস্থান করে এবং কয়েক মাস পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়িয়ে থাকে। বয়স্ক টার্কির চেয়ে তিন মাস বয়সি টার্কি মুরগি এরোগের প্রতি অধিক সংবেদনশীল।

রোগের লক্ষণ 

  • মাথার রং কালো হয়ে যায়।
  • হলদে রঙের পাতলা পায়খানা করে।
  • যকৃত ফুলে বড় হয়ে যায়।

ট্রাইকোমোনিয়াসিস রোগ

কক্সিডিওসিস এর সাথে এর মিল রয়েছে। অনেক সময় ভুলবশত একে কক্সিডিওসিস মনে হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত 6 থেকে 10 সপ্তাহের বাচ্চা আক্রান্ত হয়।

রোগের লক্ষণ– হলুদ ফেনাযুক্ত এবং অর্ধ তরল পায়খানা করে।

বটুলিজম রোগ

ক্লস্ট্রিডিয়াম বটুলিজম নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া থেকে এই রোগ সৃষ্টি হয়।

 লক্ষণ- টার্কি ঝিমাতে থাকে, গলায় শব্দ হবে, শরীরের বিভিন্ন অংশ অবসন্ন হতে দেখা যায়, ইত্যাদি।

এছাড়া মুরগি তে যেসব রোগ পরিলক্ষিত হয় তার টার্কিতে সেসব রোগ দেখা যায়। যেমন- কক্সিডিওসিস, ফাউল কলেরা, ফাউল পক্স এবং প্যারাটাইফয়েড বিভিন্ন প্রকার কৃমিতে এরা আক্রান্ত হয়। বাহ্যিক পরজীবি মাধ্যমে মাইট আক্রান্ত হয় কিন্তু উকুন থেকে এরা আক্রান্ত হয় নাআ

আরো পড়ুন: কোয়েল পাখি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *