চিটাগুড় বা মোলাসেস কী? এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত।

চিটাগুড় বা মোলাসেস

চিটাগুড় বা (Molasses) হলো আখ থেকে চিনি আহরণের সময় চিনি কলে যে গাড়, চিটচিটে এবং চিনির সমৃদ্ধ উপজাত পণ্য সংগৃহীত হয় সেটি। চিটাগুড়ের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক নাম রয়েছে, অঞ্চল ভেদে এর নাম লালি, রাব, মাতগুড় ইত্যাদি হয়ে হয়ে থাকে। বিদেশও এর নামের বৈচিত্র্য রয়েছে। ইংরেজিতে এটিকে সুগার ক্যান মোলাসেস বা মোলাসেস বলা হয়।

এটি একটি অন্যতম ফিড ইনগ্রিডিয়েন্ট যা শক্তির উৎস হিসাবে এবং যৌগিক বা রেডি ফিডগুলিতে বাইন্ডার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।শুকনো খর কে ইউরিয়া ও চিটাগুড় দ্বারা ট্রিটমেন্ট বা প্রক্রিয়াজাত করা হলে এর পুষ্টিগুণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

চিটাগুড় এর পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ

চিটাগুড় গবাদি প্রাণীর জন্য একটি বহুমুখী পুষ্টিদায়ক তরল খাদ্য। তবে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি ও মিনারেলের উৎস হিসাবে বেশি মুল্যায়িত হয়।

সাধারন পুষ্টি উপাদান ইউনিট পরিমাণ
শুষ্ক পদার্থ%৭৩.০
ক্রুড প্রোটিন%৫.৫
ক্রুড ফাইবার%০.১
এ্যাস%১৪.৬
সুগার/চিনি%৬৪.১
গ্রোজ এনার্জি/শক্তিমেগাজুল/
কেজি
১৪.৭
মিনারেল ইউনিট পরিমাণ
ক্যালসিয়ামগ্রাম/কেজি৯.২
ফসফরাস গ্রাম/কেজি ০.৭
পটাসিয়াম গ্রাম/কেজি ৫১.০
সোডিয়াম গ্রাম/কেজি ২.৪
ম্যাগনেসিয়ামগ্রাম/কেজি ৪..০
ম্যাংগানিজমিগ্রা/কেজি৭৪.০
জিংকমিগ্রা/কেজি১৮.০
কপারমিগ্রা/কেজি৬.০
আইরনমিগ্রা/কেজি১৭৩.০
এমাইনো এসিডস ইউনিট পরিমাণ
এলানিন% প্রোটিন ৭.৫
আরজিনিন% প্রোটিন ০.৬
এসপার্টিক এসিড% প্রোটিন ২২.০
সিসটিন% প্রোটিন ১.২
গ্লুটামিক এসিড % প্রোটিন ১০.০
গ্লাইসিন% প্রোটিন ১.৯
হিসটিডিন% প্রোটিন ০.৩
আইসা লিউসিন % প্রোটিন ০.৬
লিউসিন % প্রোটিন ১.২
লাইসিন% প্রোটিন ০.১
মিথিওনিন% প্রোটিন ০.৩
ফিনাইলালানিন% প্রোটিন ০.৪
প্রোলিন% প্রোটিন ১.২
সেরিন% প্রোটিন ১.৯
থ্রিওনিন % প্রোটিন ১.২
টাইরোসিন % প্রোটিন ১.৯
ভালাইন% প্রোটিন ৩.৮

গবাদি প্রাণীর খাদ্য হিসাবে চিটাগুড়ের ব্যবহার

প্রাণী সম্পদের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় চিটাগুড়ের একটি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রয়েছে। প্রাণীর শরিরে দরকারী পুষ্টি, রুচি ও শক্তি সঞ্চালন সহ নানাবিধ প্রয়োজনে রাব বা মোলাসেসের বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এটিকে কে সরাসরি খাদ্য হিসাবে খুব সামান্যই ব্যবহার হয় বেশির ভাগই ফিড ইনগ্রিডিয়েন্ট বা ফিড সাপ্লিমেন্ট হিসাবে ব্যবহার হয়। আমরা এখানে প্রায় সকল ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আসাকরি খামারি ভাইদের এটির ব্যবহারে একটি পুর্ণ ধারণা অর্জিত হবে।

বাইন্ডার ও রুচি বর্ধক হিসাবে

কমার্শিয়াল ফিড মিল গুলিতে চিটাগুড় কে বাইন্ডিং এজেন্ট হিসাবে আন্তর্জাতিক ভাবে মুল্যায়ীত হলেও বাংলাদেশে এরূপ ব্যবহার জনপ্রীয়তা পায়নি। খাদ্য পিলেট করার সময় খাদ্য কনা গুলোকে আটকে রাখতে চিটাগুড় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এতে খাদ্য পরিবহনের সময় খাদ্য ভেঙ্গে যায় না। খাদ্যের স্বাদ ও রুচি বৃদ্ধি পায়। ইউরিয়ার তিক্ততা উপশম করে। চিটাগুড় সাধারণত ২-৫% হারে ফিড মিল গুলোতে ব্যবহার করা হয়।

সাইলেজ তৈরিতে মোলাসেস

চিটাগুড় ফার্মান্টেশন প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া তরান্বিত করে। চিটাগুর রেডি ফার্মেন্টেসিবেল এনার্জি সরবরাহের মাধ্যমে ল্যকটিক এসিড ব্যকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ফলে সাইলেজের পিএইচ কমে যায় এবং উৎকৃষ্ট মানের সাইলেজ পাওয়া যায়। বেবি কর্ন ভুট্টার সাইলেজ তৈরিতে মোলাসেস প্রয়োজন হয় না কেননা এতে প্রচুর পরিমানে এনার্জি অলরেডি থেকে যায়। ঘাস জাতীয় ফসলের সাইলেজ তৈরিতে ৫% চিটাগুড় ব্যবহার করা হয়।

চিটাগুড়
চিটাগুড় বা মোলাসেস এর উপকারিতা

ইউরিয়া ক্যারিয়ার

চিটাগুড় ইউরিয়া ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সাথে বাহক বা ক্যারিয়ার হিসাবে ব্যবহার হয়ে অনেক বৈচিত্র্যময় কিছু রুমিন্যান্ট ফিড উৎপন্ন করে। এদের মধ্যে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস ও ইউরিয়া মোলাসেস মাল্টি নিউট্রিয়েন্ট ব্লক বা ইউএমএমবি অন্যতম।

ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস

ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটি ব্যপক জনপ্রিয় খাদ্য। এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ইউএমএস খুবই কস্ট ইফেকটিভ ও পুষ্টিকর। সাধারনত শুকনো খরের পুষ্টিগুণ খুবই কম হয় যা গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য হিসাবে বিবেচিত। সেই শুকনো খর কে ইউরিয়া ও চিটাগুড় দ্বারা ট্রিটমেন্ট বা প্রক্রিয়াজাত করা হলে এর পুষ্টিগুণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে কম খরচে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হয়। ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস তৈরিতে শুকনো খর, চিটাগুড় ও ইউরিয়া যথাক্রমে ৮২ঃ১৫ঃ৩ অনুপাতে ব্যবহার করা হয়।

ইউরিয়া মোলাসেস মাল্টি নিউট্রিয়েন্ট ব্লক বা ইউএমএমবি

ইউএমএমবি একপ্রকার জমাট খাদ্য যা ইউরিয়া, চিটাগুড়, গমের ভুষি, পাম কার্নেল, মিনারেল মিক্সচার, ভিটামিন, বাইন্ডিং এজেন্ট যেমন ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, সিমেন্ট ইত্যাদি সহযোগে তৈরি হয়। বিশেষকরে খাদ্যের অপ্রতুলতা ও উচ্চমূল্য তৈরি হলে এ ধরনের ব্লক ভিড অত্যান্ত কার্যকরি।

রুমিনান্ট তথা গরু ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া, উট ইত্যাদি প্রাণী সকলেই এটি খেতে পারে।

বর্তমানে মিনারেল সাপ্লিমেন্ট হিসাবে ইউরিয়া মোলাসেস মাল্টি নিউট্রিয়েন্ট ব্লক তথা ব্লক ফিড পৃথিবী জুড়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা তে এর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি তবে অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা তেও এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

শক্তির উৎস হিসাবে চিটাগুড়

চিটাগুড় প্রাণী খাদ্যে শক্তির একটি বড় উৎস। বিশেষ করে কার্বহায়ড্রেট জাতীয় শস্যের যখানে অভাব বা উচ্চ মূল্য সেখানে এর ব্যবহার বেশি। কিউবা তে গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য। এক কেজি মোলাসেসে ১৫-২০ হাজার কিলোক্যালরি শক্তি থাকে।

ফার্মান্টেড কর্ন তৈরিতে

বর্তমান সময়ে ফার্মান্টেড কর্ন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মুক্তি মাহমুদ ভাই ফার্মান্টেড কর্ন ফিডের জনপ্রিয়তা তৈরিতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এই ফার্মান্টেড কর্ন তৈরিত চিটাগুর ব্যবহার করা হয়।

মৎস্য চাষে চিটাগুড়

মৎস্য বা মাছ চাষে এই গুড়ের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার রয়েছে। এই গুড় পানির কার্বন ডাই-অক্সাইড অক্সাইডের পরিমান হ্রাস করে ও পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে। পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি তে সহায়তা করে। মাছের খাদ্যে চিটাগুড় ব্যবহার করা হয়। বায়ো ফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে ফ্লকের পানির গুনগুন ঠিক রাখতে ও উপকারী ব্যকটেরিয়া তৈরি তে এটি ব্যবহার করা হয়।

জৈব সার হিসাবে ব্যবহার

রাফেজ জৈব সার নামের একপ্রকার জৈব সার তৈরি তেএই গুর ব্যবহার করা হয়। শাক সবজি ওফল-মুলের উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে এই সার তৈরি করা হয়। ছাদ কৃষি ও বাগানের জন্য এই বিশেষ জৈব সার ব্যবহার করা হয়। এটি একটি উন্নতমানের জৈব সার। তাছারাও চিটাগুড় সরাসরি সার হিসাবে উদ্যান শিল্পে ব্যবহার করা হয়।

বেকারী শিল্পে ব্যবহার

চীন সহ পৃথিবীর অনেক দেশে উন্নত মানের বিস্কুট তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। এটি বিস্কুটের স্বাদ, ফ্লেবার ও গঠন আরো বৃদ্ধি করে। এসকল প্রডাক্টের বাজারে অনেক ডিমান্ড আছে।

অন্যান্য শিল্পে এর ব্যবহার

এছাড়াও তামাক ও এলকোহল শিল্পে ব্যপক পরিমান চিটাগুড় ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের ’কেরু এন্ড কং’ দর্শণা, চুয়াডাংগা এমন একটি চিনি কল যেখানে তাদের নিজস্য উৎপাদিত আখ থেকে বিপুল পরিমান চিনি ও চিটাগুড় উৎপাদন করে এবং নিজস্য উৎপাদিত চিটাগুড় বিক্রি না করে নিজেরাই তা দিয়ে খুবই উন্নত মানের মদ, স্পিরিট ও ভিনেগাড় তৈরি করে। এবং এ টি একটি লাভজনক চিনি কল।

বিশ্ব ব্যপি চিটাগুড় এর উৎপাদন ও ব্যবহার

২০০৭ এর হিসাব মতে সারা পৃথিবী তে ৬০ মিলিয়ন টন মোলাসেস উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ১৫.৯ মিলিয়ন টন প্রাণী সম্পদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়। মোলাসেস উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য দেশ হলো ব্রাজিল, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ইউনাইটেড স্টেটস, পাকিস্তান, ম্যাকসিকো, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া। প্রধান ব্যবহারকারীরা হলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র (১.৯ মিলিয়ন টন), চীন (১.৮ মিলিয়ন টন), ব্রাজিল (১.৩ মিলিয়ন টন), ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, ভারত, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া এবং ইরান।

রিলেটেড পেইজ- চিটাগুড়ের উপকারিতা সম্পর্কে জানুন

10 thoughts on “চিটাগুড় বা মোলাসেস কী? এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত।”

  1. ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য।

  2. mishkatbd কে অন্তরের গভীরতা থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই এমন বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক সুন্দর গবাদিপশু সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার জন্য।

  3. আপনাকেও আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনাদের মতামত আমাদের অনুপ্রানিত করে ও শক্তি যোগায়।

  4. পাইকারি হিসাবে আমি কী ভাবে মোলাসেস পেতে পারি??

  5. আলামিন

    পাইকারি হিসাবে আমি কী ভাবে মোলাসেস পেতে পারি??

  6. গো খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে
    গরু পালন খুবিই কসটোকর।

  7. অনেক অজানা গুনাগুন জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *