গরুর মিনারেল বা দরকারি খনিজ উপাদান গুলো সম্পর্কে সকল খামারিদেরই সঠিক ধারনা থাকা দরকার। কেননা গরুর শরীরে কোন একটি- মিনারেলের অভাব থাকলেও গরু থেকে আসা অনরুপ উৎপাদন সম্ভব হবে না। গরু বিভিন্ন রকম অসুখে ভুগবে। খনিজ উপাদান বা গরুর মিনারেলস গরুর স্বাভাবিক দুধ প্রধান এবং শরীর বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর তাই গরু তার খাবার থেকে সবগুলো দরকারি খনিজ উপাদান পাচ্ছে কিনা সেদিকে ভালোভাবে নযর দিতে হবে।
খনিজ উপাদান কী?
যেসকল খাদ্য উপাদান প্রাণী দেহে সামান্য পরিমান দরকার হলেও যার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য সেসকল অনুখাদ্য কেই মিনারেল বা খনিজ উপাদান বলে। যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আইরন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি।
গরু সাধারণত শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এসকল খনিজ উপাদান তার ঘাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবার থেকে পেয়ে থাকে। তবে উন্নত জাতের গরু কে বাড়তি খনিজ উপাদান সাপ্লিমেন্ট সরবরাহ করতে হয়।
গবাদিপশুর মিনারেলের শ্রেণীবিভাগ
গরুর প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান সমুহ কে সাধারনত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা-
- ম্যাক্রো-মিনারেলস
- মাইক্রো-মিনারেলস
ম্যাক্রো- মিনারেল
যে সককল খনিজ উপাদান শরীরে বেশী পরিমানে দরকার হয় সেসকল কে ম্যাক্রো মিনারেলস বলে। ম্যাক্রো খনিজ উপাদান গুলো হলো- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, আইরন, সোডিয়াম ইত্যাদি।
ক্যালসিয়াম
ক্যালসিয়াম সবচেয়ে দরকারি একটি গরুর খনিজ উপাদানের। যেহেতু দুধে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম থাকে তাই দুধ উৎপাদনের সাথে ক্যালসিয়ামের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে অধিক দুধ উৎপাদনকারী গরুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করা আবশ্যক।
ঘাস ক্যালসিয়াম এর প্রধান প্রাকৃতিক উৎস হলেও অধিক দুধ উৎপাদন গরুর জন্য অনেক সময় কৃত্তিম ভাবে ক্যালসিয়াম সরবরাহের প্রয়োজন হয়।
তাছাড়া কাঁচা ঘাস সরবরাহে ঘাটতি থাকলে কৃত্তিম ভাবে দানাদার খাদ্যের থেকে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন সরবরাহের প্রয়োজন হয়। গরুর দৈহিক ওজন, বয়স এবং দুধের পরিমানের উপর গরুর শরীরে ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজন নির্ভর করে।
ফসফরাস
গরুর শরীরে ফসফরাস এর প্রয়োজনীয়তা কখনো কখনো খুব জরুরি হয়ে পরে, বিশেষ করে উন্নত জাতের গরুর দুধ উৎপাদনের সময়ে। কেননা দুধে প্রচুর পরিমান ফসফরাস বিদ্যমান থাকে। গরুর শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস এর ভূমিকা একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত। ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস এর অভাবজনিত কারণেই মূলত মিল্ক ফিভার রোগে হয়। কাঁচা ঘাস গরুর শরীরে ফসফরাস এর প্রধান উৎস।
ম্যাগনেসিয়াম
গবাদিপশুর আরেকটি দরকারী খনিজ উপাদান হলো ম্যাগনেসিয়াম। কাঁচা ঘাস গরুর শরীরে ম্যাগনেসিয়াম এর প্রধান উৎস। ম্যাগনেসিয়ামের আরেকটি কৃত্রিম উৎস হলো ম্যাগনেসিয়াম সালফেট।
পটাসিয়াম
কাঁচা ঘাসে পটাসিয়াম এর মাধ্যমে চাহিদা পর্যাপ্ত পুরন হয় না বিধায় প্রায় সকল গরুকে কৃত্তিম উৎস থেকে পটাসিয়াম সরবরাহ করতে হয়। পটাসিয়াম এর অভাবে গরুর শরীরে আয়নিক ইমব্যালেন্স হয়ে থাকে এবং এতে গরু মারাও যেতে পারে, বিশেষ করে অতি গরমের সময়।
সোডিয়াম এবং ক্লোরিন
সোডিয়াম ও ক্লোরিন দুই খুব গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। খাবার লবন হলো সোডিয়াম এবং ক্লোরিন এর প্রধান উৎস। সোডিয়াম এবং ক্লোরিন এর অভাবে ও গরুর শরীরে আয়নিক ইমব্যালেন্স হয়ে থাকে।

মাইক্রো- মিনারেল
যে সককল খনিজ উপাদান প্রাণীর শরীরে খুব কম পরিমানে দরকার হয় সেসকল কে মাইক্রো-মিনারেলস বলে। মাইক্রো-খনিজ উপাদান গুলো হলো- জিংক, আয়রন, কপার ইত্যাদি। এর বেশির ভাগই গরু ঘাসের মাধ্যমে সরবরাহ পেয়ে থাকে। তবে বিশেষ প্রয়োজন এর ক্ষেত্রে মাল্টি খনিজ উপাদান কম্বিনেশন থেকেও কৃত্তিম ভাবে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
সকল প্রাণীর খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হলো মিনারেলস। সকল মিনারেলই সমান গুরুত্বপূর্ণ তবে সকল মিনারেল সমান ভাবে প্রয়োজন হয় না। গরু কাচা ঘাস ও খাদ্য লবন থেকে মিনারেল বা খনিজ উপাদান গ্রহন করে।
ফিড সাপ্লিমেন্ট হিসাবে লাইমস্টোন, DCP, MCP, বিট লবন, রক সল্ট ব্যবহার করা হয়।
ছাগল গরুর মিনারেল সাপ্লিমেন্টস
বাজারে প্রচুর মিনারেল সাপ্লিমেন্টস বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন কম্পোজিশনে পাওয়া যায়। দাম ও সাপ্লাই এর উপর নির্ভর করে যেকোন বিশ্যস্ত কোম্পানির এই সাপ্লিমেন্ট খাওয়ালেই চলে। নিম্নে কিছু প্রকার খনিজ উপাদান সাপ্লিমেন্টস এর বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস সাপ্লিমেন্টস
গবাদিপশুর শরীরে বেশি পরিমানে যে সকল খনিজ উপাদান প্রয়োজন হয় সেগুলোর জন্য কমার্শিয়ালি কিছু ঔষধ রয়েছে। এই ঔষধ গুলি নিয়মিত প্রাণী খাদ্যে সরবরাহ করলে প্রাণীর শরীরের খনিজ উপাদানের ঘাটতি পুরন হয় গবাদিপশু সুস্থ থাকে। যেমন- সানক্যালভেট ওরাল/পাওডার, বোনাক্যাল পি ওরাল/পাওডার, ক্যাল-পি ওটাল/পাওডার।
ছাগল গরুর ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্ট
বাজারে প্রায় সকল কোম্পানির এই সাপ্লিমেন্ট টি আছে। এবং এটি একটি চাহিদার প্রডাক্ট। প্রতিটি গবাদিপশু, হাঁস মুরগির প্রতি ২-৩ মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্ট হিসেবে সরবরাহ করতে হয় নতুবা দানাদার খাদ্যের সাথে নিয়মিত ও পরিমিত ভাবে সরবরাহ করতে হয়।
এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারে সুবিধা হলো গবাদিপশুর শরীরের সকল দরকারি ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব পুরন হয়। ফলে গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বাজার থেকে ভিটামিন খনিজ উপাদানের সাপ্লিমেন্ট কেনার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
পরিক্ষিত ও বিস্যস্ত কোম্পানির সাপ্লিমেন্ট কিনতে হবে কেননা বর্তমানে বাজারে প্রচুর ভেজাল ঔষধ পাওয়া যায়।
- গরুর জন্য- ক্যালফস টনিক পাওডার, মেগাভিট ডিবি, ডিবি ভিটামিন, রেনাভিট ডিবি প্রভৃতি।
- মুরগির জন- রেনা গ্রোয়ার, রেনা ডাব্লিউএস প্রভৃতি।
গরুর মিনারেল ব্লক
মিনারেল ব্লক বা ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক গবাদিপশুর জন্য খনিজ উপাদান এর একটি সহজ সমাধান। কেননা এটি যেকেউ বাড়িতে বা খামারে এই ব্লক বানিয়ে গবাদিপশু তে সরবরাহ করা যায়।
গমের ভুষি, সয়াবিন মিল, ইউরিয়া, চিটাগুড়, চুন, লবণ ও ভিটামিন মিনারেল মিক্সার ব্যবহার করে এই মিনারেল ব্লক খুব সহজেই বানান যায়। এটি গবাদিপশু তথা রুমিনান্ট প্রাণীদের জন্য উচ্চ প্রোটিন ও খনিজ উপাদান সাপ্লিমেন্ট।
এই ব্লক থেকে গবাদিপশু প্রচুর শক্তি বা ক্যালোরি পয়ে থাকে। গরু ও ছাগল মোটাতাজাকরণ করতে এই ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক বা UMMB খুবই কার্যকারি।
খনিজ উপাদান এর ন্যাচারাল উৎস
প্রাকৃতিক উৎস থেকেও আমরা গবাদিপশুরখনিজ উপাদান সরবরাহ বাড়াতে পারি। নিম্নে গবাদিপশুর কয়েকটি খনিজ উপাদান সাপ্লিমেন্ট এর বিবরণ তুলে ধরা হলো।
কাঁচা ঘাস
কাঁচা ঘাস গবাদিপশুর প্রধান খনিজ উপাদান এর উৎস। সাধারণত যেসব গরু কাঁচা ঘাস কম পায় তাদেরই খনিজ উপাদান এর অভাব হয়ে থাকে। দানাদার খাদ্য থেকেও গরু খনিজ উপাদান পেয়ে থাকে। তবে খাদ্য ব্যবস্থাপনা না হলে সকল গবাদিপশুর শরীরে খনিজ উপাদান এর ঘাটতি দেখা দেবে।
চিটাগুড়/মোলাসেস
চিটাগুড় একটি সহজ লভ্য ও কম দামের ভালো খনিজ উপাদান এর উৎস। কম দামের এই জন্য বলছি যে – চিটাগুড়ে যে পরিমান খনিজ উপাদান পাওয়া যায় সেটা কমার্শিয়ালি কিনতে গেলে অনেক বেশি খরচ হবে। তাছাড়া চিটাগুড়ের দাম অন্যান্য খাদ্যের তুলনায় কম। চিটাগুরে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ইত্যাদি খনিজ উপাদান পাওয়া যায়।
রক সল্ট/সন্ধক লবণ
রক সল্ট বা সন্ধক লবন গবাদিপশুর একটি অন্যতম খনিজ উপাদান। এটিকে হিমালয়ান পিংক সল্টও বলা হয়। এই লবণে ৮২ টি ওরগানিক খনিজ উপাদান পাওয়া যায়।
গবাদিপশু কে এই লবন খন্ড আকারে সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় আর গবাদিপশু এটিকে চাটতে থাকে। এই চাটার ফলে গরুর শরীরে নানাবিধ উপকার সাধিত হয়।
রক সল্টে প্রচুর পরিমানে আয়রন থাকে বলে এই লবণ দেখতে গোলাপি রঙের হয়।
ব্লাক সল্ট/বিট লবণ ও খাদ্য লবণ
ব্লাক সল্ট বা বিট লবণ একটি খনিজ লবণ। এই লবণ খাওয়ালে গরুর শরীরের খনিজ উপাদান এর ঘাটতি পুরণ হয়। এছাড়াও খাদ্য লবণ থেকে গবাদিপশু সোডিয়াম ও ক্লোরিন পেয়ে থাকে।
আরো পড়ুন- গমের ভুষি, এর ব্যবহার ও দাম
গরুকে চুনাপাথর কিভাবে খাওয়াব এবং কোথায় পাব?