গরুর গলাফুলা রোগ ও এর চিকিৎসা পদ্ধতি। গরুর গলাফুলো রোগ গবাদিপশুর রোগ সমুহের মধ্যে একটি অন্যতম রোগ। প্রায়ই আমরা বিশেষ করে গরু ও মহিষে এই রোগ টি দেখতে পায়। এই রোগের মৃত্যুর হার বেশি থাকে। সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে এই রোগ সহজেই ভালো হয়ে যায়।
তবে শারীরিক ভাবে দুর্বল ও অধীক কৃমিতে আক্রান্ত থাকলে অনেক ক্ষেত্রে গরু মারা যায়। আর তাই খামারিকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। রোগ দেখা দিলে দ্রুত ভেটিরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে চিকিৎসা নিতে হবে। খামারি এই রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকলে খামারকে গরুর গলাফুলা রোগ থেকে মুক্ত রাখা কোন ব্যাপারই না।
রোগ পরিচিতি
রোগের নাম | গলাফুলা রোগ (Haemorrhagic Septicemia) |
রোগের ধরণ | ব্যাকটেরিয়া ঘটিত |
জীবাণুর নাম | পাস্তুরেলা মাল্টোসিডা (Pasteurella multocida) নামক গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া |
সংক্রমণ | গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি |
মৃত্যুর হার | বেশি |
সংক্রমণের বয়স | সকল বয়সে |
চিকিৎসা | চিকিৎসায় অথিকাংশ প্রাণি সুস্থ্য হয়। |

গরুর গলাফুলা রোগ কী?
পাস্তুরেলা মাল্টোসিডা (Pasteurella multocida ) নামক এক ধরনের গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গরু বা মহিষ সংক্রমিত হলে এই রোগ হয়ে থাকে। এই রোগ কে অনেকেই গ্রামের ভাষায় টুটি ফোলা বা চোয়াল ফুলা রোগ বলে।
এছাড়াও ব্যাংগা, ঘটু, গলগটু, গলবেরা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই রোগ হলে গরুর থুতনি বা টুটি ফুলে যায়। সাধারণত বর্ষা কালের শুরু ও শেষে গরুর গলাফুলা রোগের প্রদূর্ভাব বেশি দেখা য়ায়।
অধিক ঠান্ডা বা গরমের কারনে, কৃমি জনিত কারণে ও ভ্রমন জনিত কারণে যদি স্ট্রেজ বা পীড়নের সৃষ্টি হয় তাহলে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
গবাদিপশুর গলাফুলা রোগের কারণ
গবাদিপশুর গলাফুলা রোগ (hemorrhagic septicemia) একটি ব্যাকটেরিয়া জনীত রোগ। যা পাস্তুরেলা মাল্টোসিডা (Pasteurella multocida ) নামক এক ধরনের গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হলে এই রোগ হয়ে থাকে। সারা পৃথিবীতে এই রোগের প্রদূর্ভ দেখা যায়। গরু অধীক পরিমানে লিভার কৃমিতে আক্রানাত হলে ও অপুষ্টি বা রক্ত সল্পতা থাকলে এই রোগ জটিল আকার ধারণ করে।
এছাড়াও গরুর উপর স্ট্রেজ বা ধকল তৈরী হলে এই রোগ হতে দেখা যায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন জনিত সমস্যায় এই রোগ দেখা দেয়। বিশেষ করে বর্ষা শুরু ও শেষে।

গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ সমূহ
এ রোগ অতি তীব্র ও তীব্র এ দুই প্রকৃতির হতে পারে। খামারির বোঝার সুবিধার্থে অতি তীব্র ও তীব্র এ দুই প্রকৃতির লক্ষণ আলাদা আলাদা ভাবে দেওয়া হলো-
অতি তীব্র সংক্রমণের লক্ষণ
- হঠাৎ শরীরের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট উঠে যায়।
- গবাদিপশুর নাক ও মুখ দিয়ে তরল শ্লেষা বের হয়।
- অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে ও খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়।
- লক্ষণ প্রকাশের ২৪ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়।
তীব্র সংক্রমণের লক্ষণ
- তীব্র প্রকৃতির সংকমণ হলে গরু ২৪ ঘন্টার বেশি বেচে থাকে
- গরুর চোয়ালে এডিমা দেখা যায় ও চোয়াল ফুলে যায়।
- ফুলা অংশে ব্যাথা থাকে।
- ফুলা অংশ ছুচ দিয়ে ছিদ্র করলে হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ বে হতে দেকা যায।
- প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হয়।
- অনেক সময় জিহব্বা বের হয়ে আসে।
- সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিনের মধ্যে গরু মারা যায়।
রোগের প্রাদুর্ভাব
সারা বছরই এই রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা যায়। বিশেষ করে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়, প্রচন্ড শীত বা গরমের সময়, বর্ষার শুরুতে বা শেষে এই গরুর গলাফুলা রোগ বেশি দেখা যায়। স্বাভাবিক অবস্থাতে এই রোগের জীবাণু গরু বা মহিষের দেহে উপস্থিত থাকলে। তবে গরু বা মহিষের দেহে বিভিন্য প্রকার ধকল যেমন- প্রচন্ড কৃমি রোগে আক্রান্ত হলে, পশুকে দিয়ে অধীক কাজ করালে, দীর্ঘদিন খাবার সমস্যা থাকলে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
হেমোরেজিক সেপটিওসেমিয়া বা গলাফুলা রোগ টি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গরু এবং মহিষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ছাগল ও ভেড়া তেও এই রোগ হয়। আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের কিছু অংশে এবং মধ্য প্রাচ্যে এই রোগ সচারচর দেখা যায়। বছরের প্রায় সব সময়েই গরুর গলাফুলা রোগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও বর্ষাকাল এবং বর্ষার শেষে প্রাদুর্ভাব একটু বেশি থাকে।
বাড়ন্ত বয়সের গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে রোগের প্রকোপ এবং মৃত্যুর হার বেশি হয়। আর যেসব গবাদিপশুর বয়স ৬-১৮ মাস তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমন বেশি হয়। সাধারণত মহিষে গরুর তুলনায় তিনগুণ বেশি এই গলাফুলা রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত যেসব এলাকায় মহিষকে চাষাবাদের কাজে ব্যবহার বেশি সেই সব এলাকা তে এই রোগ বেশি দেখা যায়। দেখা গেছে নিচু এলাকায় এর রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে।।
গরুর গলাফুলা রোগের বিস্তার
সারা পৃথিবীতে এই রোগের বিস্তার থাকলেও এশিয়া ও আফ্রিকাতে গরুর গলাফুলা রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি দেখা যায়। আমাদের পার্শবর্তি দেশ ভারতে গবাদিপশুর গলাফুলা রোগের বিস্তার অনেক বেশি। আক্রান্ত পশু থেকে সুস্থ্য পশুতে এই ব্যাকটেরিয়া টি সহজেই ছরাতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া মাটি ও বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।
গরুর গলাফুলা রোগ প্রতিরোধের উপায়
এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকা প্রায় অসম্ভব তার কারণ এ রোগের জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থায় পশুর দেহে বিরাজ করে। তবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
- গরুর গলাফুলা রোগে আক্রান্ত হলে সুস্থ গরু থেকে আলাদা করতে হবে। এবং সুস্থ গরু গুলোকে টিকা প্রোদানের ব্যবস্থা গ্রকণ করতে হবে।
- আসেপাশে এই রোগ দেখা দিলে সময় গরুর চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় ও বর্ষা কালে গরুর প্রতি বাড়তি পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে।
- গরুকে সময় মত এবং নিয়মিত কুমিনাশক ঔষধ প্রোয়গ করতে হবে।
- গরুকে দিয়ে অধীক খাটুনি ও খাদ্যাভাবে রাখা যাবে না।
- টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমেও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
গবাদিপশুর গলাফুলা রোগের ভ্যাকসিন
বাংলাদেশের লোকাল স্টেইন থেকে ঢাকার এল.আর. আই কতৃর্ক প্রস্তুতকৃত গরুর গলাফুলা রোগের টিকা বা ভ্যাকসিন প্রতিটি উপজেলা প্রারীসম্পদ অফিসে পাওয়া যায়। গরুর গলাফুলা রোগের ভ্যাকসিন মুলত দুই প্রকারের হয়। যথা- অয়েল এডজুভেন্ট (Oil Adjuvent) ভ্যাকসিন ও এলাম অধঃপাতিত (Alum precipitated)। এবং এই ভ্যাকসিনের দামও খুব কম।
সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক গরু বা মহিষকে ২ মিলি মাত্রায় ও ছাগল বা ভেড়াকে ১ মিলি মাত্রায় অয়েল এডজুভেন্ট ভ্যাকসিন বা টীকা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হয়। এটি অয়েল এডজুভেন্ট টিকা যা তেল থেকে প্রস্তুতকৃত বিধায় এই টিকা সাবধানতার সাথে গরুর মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। তবে এলাম অধঃপাতিত (Alum precipitated) টিকা মংসে প্রয়োগ করতে হয়।
গরুর গলাফুলা রোগের ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদানের ২-৩ সপ্তাহ পর থেকে সাধারণত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাতে শুরু করে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ১ বৎসর কাল পর্যন্ত বজায় থাকে।
প্রাথমিক চিকিৎসা ও করণীয়
গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হলে পশুর চিকিৎসায় কোন প্রকার বিলম্ব হলে সুফল পাওয়া যাবে না। আর তাই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গরুর গলাফুলা রোগের চিকিৎসায় সালফোনামাইড গ্রুপ এর ঔষধ যেমন- সালফাডিমিডিন, ট্রাইমিথোপ্রিম-সালফামেথাক্সাসোল কম্বিনেশন, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন ও ক্লোরামফেনিকল জাতীয় ঔষধ অধিক কার্যকর।
গবাদিপশুর গলাফুলা রোগ একটি মারাত্বক ব্যাকটেরিয়া জনীত রোগ। এই রোগের সংক্রমনে মৃত্যুর ঝুকি অনেক বেশি। আর তাই এই গরুর গলাফুলা রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে ও ভ্যাকসিন প্রদান করতে হবে।
মহিষ বা গরুকে দিয়ে বেশি পরিশ্রম করান যাবে না। গরুর ইপর যেন অধীক ধকল না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি গরুর গলাফুলা রোগ দেখা দিরে দ্রুত পিকিৎসকের পরামর্শ ক্রমে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
আরো পড়ুন- বাছুরের রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস রোগ