কই মাছ প্রচন্ড সুস্বাদু ও রোগ প্রতিরোধি মাছ। বাজারে কই মাছের দামও সবসময় বেশি থাকে। দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে কই অন্যতম। এই মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি অত্যান্ত পুষ্টি গুণেও অতুলণীয়। খাল-বিলে এই মাছ প্রচুর পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের খাল-বিল কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে এখন এই মাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না। মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে এখন বড় পরিসরে আবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কই মাছের শ্রেণীবিন্যাস
কিংডম: অ্যানিমালিয়া (Animalia)
ফাইলাম: কোর্ডটা (Chordata)
ক্লাস: অ্যাক্টিনোপার্টিগেই (Actinopterygii)
অর্ডার: এনাবেনটিফরমেস (Anabantiformes)
পরিবার: এনাবেনটিডা (Anabantidae)
জেনাস/বংশ: এনাবাস (Anabas)
প্রজাতি: এনাবাস কম্বোজিয়াস (Anabas cobojius)
কই মাছ পরিচিতি
মাছের নাম | কই মাছ (koi fish) |
মাছের বৈজ্ঞানিক নাম | এনাবাস টেস্টাডাইনাস (Anabas testudineus) |
প্রচলিত নাম | কৈ, কৈ মাছ ইত্যাদি |
দৈহিক গঠন | কই মাছের মাথা বড় ও ত্রিকোণাকৃতি হয়। দেখতে কালচে-সবুজ বা বাদামী-সবুজ হয়। এদের সারা দেহ আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে। এদের মুখের দুই চোয়ালে শক্ত দাঁত থাকে। পিঠের পাখনায় ধারালো কাঁটা থাকে। |
প্রাপ্তি স্থান | ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, নেপাল, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে। |
জলাশয় | নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ও পুকুরের পানির বসবাস করে। |
রোগ | এই মাছের তেমন কোন বিশেষ রোগ নেই। পানি বাহিত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্ষতরোগ, পাখনা পচা, ফুলকা পচা, লেজ পচা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। |
খাদ্য | ছোট অবস্থায় খাদ্য হলো জুপ্লাংটন। পুকুরে কৈ মাছ চাষ করছে বাড়তি খাবার দিতে হয়। |
উৎপাদন | কৈ অধিক উৎপাদনশীল না হলেও খাদ্য ব্যবস্থাপনা ভালো হলে ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়। |
প্রজনন | এই মাছ ৪-৫ সেন্টিমিটার বড় হলেই প্রজননক্ষম হয়। বর্ষাকালে এই মাছ প্রজনন করে। ধানক্ষেত, খাল-বিল, ডোবা, নালা ইত্যাদি স্থানে প্রজনন করে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার ঘটান যায়। |
বাজার দাম | এই মাছের বাজার মূল্য খুবই ভালো। বাজারে কই মাছের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা প্রতি কেজি। |
স্বাদ ও পুষ্টি
কই মাছ অত্যান্ত সুস্বাদু একটি দেশি জাতের মাছ। এই মাছের তরকাড়ি বাঙ্গালীদের কাছে অমৃতের মত। মাছের যে কতটা স্বাদ হতে পারে তা দেশি কই মাছের তরকারি না খেলে বোঝার উপায় নেই। পুষ্টির দিক থেকেও এই মাছ সেরা। এই মাছে পর্যাপ্ত ফ্যাট, আয়রণ, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস পাওয়া যায়।
পানি | ৭০ |
প্রোটিন | ১৪.৮ |
ফ্যাট | ৮.৮ |
আয়রণ | ১.৩৫ |
ক্যালসিয়াম | ০.৪১ |
ফসফরাস | ০.৩৯ |
কার্বোহায়ড্রেট | – |
ক্যালোরি | – |
কৈ মাছ চাষ পদ্ধতি
কই মাছ পুকুরে মাছ চাষ করা যায়। পুকুরের জলাশয়ে কই মাছের চাষ পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হলো। কই মাছ মূলত কীট-পতঙ্গভূক। এ কারণে পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙাচী, শামুক বা ঝিনুকের মাংস ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে সরবরাহ করে এ মাছ চাষ করা হলে খাদ্য খরচ কম হয়।
- থাই কই
- ভিয়েতনাম কই
- দেশি কই

কৈ মাছ চাষের সুবিধা
- যে কোন ধরণের চৌবাচ্চা, জলাশয় এমনকি খাঁচায়ও চাষ করা যায়।
- এরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়, সাধারণত চার মাসে বাজারজাত উপযোগি হয়।
- শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য কই মাছের বাড়তি অঙ্গ থাকায় তাজা অবস্থায় মাছ বিক্রয় করা যায়।
- পুষ্টিগুন অনেক বেশি, সুস্বাদু তাই বাজার মূল্য অনেক বেশি পাওয়া যায়।
- প্রতিকুল পরিবেশে এরা বেঁচে থাকতে পারে এবং এদের মৃত্যুর হার খুবই কম।
- অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।
- রোগবালাই খুবই কম।
- বায়োফ্লক পদ্ধতিতেও এই মাছ চাষ করা যায়।
- তুলনামূলক অল্প পঁজিতেই চাষ করা সম্ভব।
পুকুর প্রস্তুতি
- প্রথমে পুকুরকে সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন।
- এরপর মাটিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- পুকুরের চারদিক পরিষ্কার করতে হবে এবং আলো চলাচল ভালো রাখতে হবে।
পুকুরে বেষ্টনি প্রদান ও পোনা মজুদ
কই মাছ অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ দিয়ে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে পানির উপরে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। বৃষ্টির সময় এরা তাদের কান ব্যবহার করে দ্রুত চলাফেরা করতে পারে। আর সেজন্য পুকুর পাড় অবশ্যই নাইলনের ঘন জাল দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। কৈ মাছের সাথে শতকে ২০ টি মাগুর অথবা ১০ টি শিং মজুদ করে চাষ করা যেতে পারে।
কই মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য কৈ চাষের জন্য উপযোগী। এদের খাবারে প্রাণীজ প্রোটিন বেশী হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য গ্রোথ প্রোমোটর, ভিটামিন ও এনজাইম খাদ্যের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে যেতে পারে।
রেনু পোনা মজুদের পরের দিন থেকে মাছকে তার দেহ ওজনের ১৬ ভাগ থেকে আরম্ভ করে দৈনিক খাবার দিয়ে যেতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর খাদ্য প্রয়োগের হার ১% করে কমাতে হবে। মাছের ওজন ৫০ গ্রামের উর্ধ্বে উঠলে খাদ্য প্রয়োগের পরিমান তার দেহ ওজনের শতকরা ৫ ভাগ হতে হবে।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
- পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে।
- কৈ মাছ চাষে প্রথম দুই মাস নিয়মিত (প্রতি ১৫ দিন অন্তর ২০-২৫% পানি পরিবর্তন) পানি পরিবর্তন করতে হবে।
- ফাইটোপ্লাঙ্কটনের প্রতি কৈ মাছের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। এ কারণে পানিতে ফাইটোপ্লাঙ্কটন ব্লুম থাকা যাবে না। কৈ চাষের পুকুরে চাষকালীন সারের তেমন প্রয়োজন হয় না।
চারমাসে থাই কই প্রতিটির গড় ওজন হবে ৭০-৮০ গ্রাম। চারমাসে ভিয়েতনামি কৈ মাছ প্রতিটির গড় ওজন হবে ১৫০-২০০ গ্রাম। চারমাস পর থেকেই আংশিক বা সম্পূর্ণ মাছ বিক্রয় করা যায়। খামারিদের জন্য কৈ মাছের চাষ একটি লাভজনক উদ্যোগ হতে পারে।
আরো পড়ুন- কাতলা মাছ পরিচিতি ও চাষ পদ্ধতি